প্রতিপক্ষের প্রতি আমরা উদার। আমরা চাই শান্তি। সে জন্য দরকার সমন্বয় ও ঐক্য। কিন্তু আমাদের সমন্বয়-সমঝোতা ও বৃহৎ ঐক্যের আহ্বান প্রতিপক্ষ গ্রহণ করছে না। তারা কথায় কথায় লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। আমাদের নমনীয়তাকে তারা দুর্বলতা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। বিশ্বাস না হলে তোমরা তোমাদের পত্রিকা দেশ দর্শনের পক্ষ থেকে সমঝোতা ও সমন্বয়ের একটা উদ্যোগ গ্রহণ করে দেখতে পারো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি।
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী একজন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক। ‘মত ও পথ’ নামে একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনামূলক পাক্ষিকের সম্পাদক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য এবং বর্তমান সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় চিন্তা ও রাজনৈতিক সক্রিয়তায় তিনি ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব।
জাকির মাহদিন : আপনি একজন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ইসলাম নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেন, লেখেনও। আপনি সংসদ সদস্য হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী যারপরনাই আশান্বিত হয়েছিল যে এবার আওয়ামী লীগ সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হুজুরদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদরাসা শিক্ষিতদের দীর্ঘদিনের যে দূরত্ব তা ঘুচে যাবে। কিন্তু হল সম্পূর্ণ উল্টো। এখন সারাদেশে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল। কিন্তু একমাত্র আপনার নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হুজুর-মাওলানাগণ। এর কারণ কি?
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের প্রতিপক্ষ হুজুর-মাওলানাগণ- কথাটা সঠিক নয়। উনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করেন। আমার কাছেও তারা আসেন, কথা বলেন। কোনো দরকার হলে বলেন, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করি। জামেয়া ইউনুছিয়ার শতবর্ষ অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথিদের বিশেষ ব্যবস্থায় আমরা ভিসার ব্যবস্থা করেছি। এ বছরও তাই করেছি। কিন্তু তারা শর্ত ভঙ্গ করেছেন।
(তার এর আগের সাক্ষাৎকারটি পড়ুন এখানে- শুধু নির্বাচনের নাম গণতন্ত্র নয়)
প্রশাসন শর্ত দিয়েছিল ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে কোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা উসকানিমূলক বক্তব্য ও গালাগালি করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতা নষ্ট করা যাবে না। এটা সাধারণ জনগণের এবং ধর্মীয় স্বার্থেই। কিন্তু তারা এ শর্ত একদমই মানেননি। আমাকে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে যে রকম গালাগালি করেছে, উসকানীমূলক বক্তব্য দিয়েছে তাতে ভবিষ্যতে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিলে আমার কিছু করার থাকবে না। এ সম্পর্কে দায়িত্ববানদের স্মরণাপন্ন হলে তারা কিছু জানেন না বলে জানান। এটা তো সুস্পষ্ট মিথ্যাচার। আলেম হয়ে কি এমন মিথ্যাচার করা যায়? হযরত মুহাম্মদ সা. কি বলেননি যে মিথ্যা হল সমস্ত পাপের মা? একটা মিথ্যাকে ঢাকতে আরও দশটা মিথ্যা বলতে হয়।
জাকির মাহদিন : আপনার সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড কি প্রমাণ করে না যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হুজুর-মাওলানাগণই এখন আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ?
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : এর কারণ সাম্প্রতিক দুয়েকটি ঘটনা, যা আমাকে এবং দেশের অসংখ্য মানুষকে প্রবলভাবে মর্মাহত করেছে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পদ (২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ‘জামেয়া ইউনুছিয়া’ মাদরাসার ছাত্র হাফেজ মাসুদের মৃত্যু/হত্যাকে কেন্দ্র করে রেলস্টেশন ও ওস্তাদ আলাউদ্দীন সঙ্গীতাঙ্গনে ব্যাপক ভাঙচুর) অবলীলায় ধ্বংস করেছে। জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করেছে। এটা আমার কাছে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশ্ন নয়, সমগ্র বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন। এরপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রতি নমনীয়। যে মাদরাসা-ছাত্রের (হাফেজ মাসুদ) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ভয়াবহ তাণ্ডব, সেই হাফেজ মাসুদের মৃত্যুর জন্য পুলিশ কতটা দায়ি তা আমি এখনো নিশ্চিত নই। ময়না তদন্তের রিপোর্টে পুলিশের ‘গুলিতে’ নিহত হওয়ার কোনো উল্লেখ নেই।
এবং মুফতি মুবারক উল্লাহ সাহেবকে আমি জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি নিশ্চিত যে আপনাদের মসজিদ ও মাদরাসায় ছাত্রলীগ এবং পুলিশই ঢুকেছে, ভাঙচুর করেছে? তিনি বললেন, ‘সন্ত্রাসীরা’ ঢুকেছে, ভাঙচুর করেছে। তুমি নিজস্ব অনুসন্ধানে আমাকে প্রমাণ দাও যে হাফেজ মাসুদকে পুলিশই হত্যা করেছে। এমনও তো হতে পারে, ঘটনাক্রমে মাসুদ ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। গত কদিন আগে আবার ভাদুঘর মাদরাসার সামনে আরেক ইসলামি দলের পাখা মার্কা প্রার্থীকে (গত পৌরসভা নির্বাচনে) মারধর করা হয়েছে। এটা কেন? তিনি তো ইসলামেরই লোক, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে প্রার্থী হয়েছেন। মুনিরুজ্জামান সিরাজী এ ব্যাপারে কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
জাকির মাহদিন : আপনার প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের আপনি কীভাবে দেখেন?
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের প্রতি আমার আহ্বান, গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আপনারা আমাদের মোকাবেলা করুন। মোকাবেলা থাকবেই, থাকতেই হবে। নতুবা সেটা গণতন্ত্র হবে না। যদি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ প্রশ্ন তুলেন, তাহলে বলব, রাজনীতিতে আপনারা ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করুন। মিথ্যা কথা পরিহার করুন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গ ত্যাগ করুন। তখন অবশ্যই নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বা মোকাবেলার মাঠ সবার জন্য সমান দেখতে পাবেন।
জাকির মাহদিন : সারা জীবন কি শুধু মোকাবেলা মোকাবেলাই জপবেন? প্রতিপক্ষের প্রতি সমন্বয়, সমঝোতা এবং ন্যূনতম নমনীয়তার মানসিকতা নেই? গণতন্ত্র মানে কি প্রতিপক্ষ না থাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করা?
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : বলো কি! অবশ্যই প্রতিপক্ষের প্রতি আমরা উদার। আমরা চাই শান্তি। সে জন্য দরকার সমন্বয় ও ঐক্য। কিন্তু আমাদের সমন্বয়-সমঝোতা ও বৃহৎ ঐক্যের আহ্বান প্রতিপক্ষ গ্রহণ করছে না। তারা কথায় কথায় লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। আমাদের নমনীয়তাকে তারা দুর্বলতা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। বিশ্বাস না হলে তোমরা তোমাদের পত্রিকা দেশ দর্শনের পক্ষ থেকে সমঝোতা ও সমন্বয়ের একটা উদ্যোগ গ্রহণ করে দেখতে পারো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। তোমরা চাইলে চিন্তাগত ও জ্ঞানগত আলোচনার একটা নিরপেক্ষ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারো। আমি সাথে থাকবো এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা করবো।
তারা এ পর্যন্ত কী কী করেছেন সেদিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই না। কারণ আমরাও ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই, যেহেতু আমরা মানুষ। রাজনৈতিক কুসংস্কৃতি, পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি ও ওজর-আপত্তির বাইরে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনার ক্ষেত্র বা ‘গোলটেবিল বৈঠকের’ ব্যবস্থা করতে পারো। ইনশাআল্লাহ সবার আগে সেখানে আমি উপস্থিত হব। বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার সাহেবের (মরহুম) সঙ্গে আমি কাজ করেছি। এছাড়াও অনেক হুজুর-মাওলানার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
জাকির মাহদিন : ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূর করার কোনো সহজ পথ-পদ্ধতি আছে কি?
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : অবশ্যই আছে। ধৈর্য, সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা। তুমি আমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারো, এটা তোমার অধিকার, তোমার স্বাতন্ত্র্য, জীবনের বৈচিত্র্য। কিন্তু তুমি আমাকে অবজ্ঞা ও আক্রমণ করে কথা বলবে কেন? কথা বলো সুন্দর ও উত্তম যুক্তি দিয়ে। মোকাবেলা করো উত্তম আচরণ ও কৌশল দিয়ে। সবার সঙ্গে সমন্বয় ও ঐক্যের জায়গাটি চিহ্নিত করো এবং মহৎ উদ্দেশ্য অন্তরে ধারণ করো।
আমি মহান আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল। ক্ষমতার জন্য লালায়িত নই। তিনিই সকল ক্ষমতার উৎস। প্রতিপক্ষের প্রতি আমার অনুরোধ, আসুন, আমরা বসি, আলোচনা করি। আমাদের গণ্ডিবদ্ধ শিক্ষা, সংকীর্ণ চিন্তা ও দূরত্বগুলো মিটিয়ে ফেলি। দেশ জাতির সামগ্রিক স্বার্থে একটি বৃহৎ ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। বাংলাদেশকে একটি সর্বাধুনিক, স্বনির্ভর ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আমরা দেখতে চাই। আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে, আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি না, আর যা বিশ্বাস করি তা বলি না। আমরা খুব সহজেই কাউকে কাফের, নাস্তিক বলে ফেলি। আরে, ইসলাম তো কাফের-মুশরেক ও নাস্তিকদের জন্যই এসেছে?
আমি আমার অন্তরের গভীর থেকে বলছি, আমি সকলের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে চাই। আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি। কোরআন-হাদিস মান্য করি। আপনাদের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, আসুন, আমরা একযোগে কাজ করি। একটি সুন্দর শান্তিময় বাংলাদেশ এবং সুন্দর শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলি।
তোমার মাধ্যমে আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই, আসুন আমরা একসঙ্গে বসি, আলোচনা করি। পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝিগুলো মিটিয়ে ফেলি। সকলে মিলেমিশে থাকি এবং কাজ করি। চিন্তা ও জ্ঞানগত আলোচনা এবং ইলম চর্চার মাধ্যমে আমাদের কর্মকাণ্ড ও নিয়তের উন্নতি ঘটাই। আমার ভেতরে আল্লাহর রহমতে কারো প্রতি কোনো হিংসা, বিদ্বেষ বা ঘৃণা নেই। আল্লাহ সবার মঙ্গল করুন।
জাকির মাহদিন : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : তোমাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ দর্শন সম্পাদক জাকির মাহদিন
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, সাক্ষাৎকার
[sharethis-inline-buttons]