স্বাস্থ্যখাতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের উন্নয়নের কোনো রূপ ধারণা করা সম্ভব নয়। যে কোনো উন্নয়নশীল দেশই মূলত সবচেয়ে বেশি নজর দেয় দেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে। তবে এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়েই আছে বাংলাদেশ। প্রতি অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেটের কতটুকু আদতে ঠিকমতো ব্যয় হচ্ছে তার নেই কোনো সঠিক হিসাব।
দৃশ্যপট-১: মনোয়ার সাহেব (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ভুগতে থাকা হার্টের সমস্যা নিয়ে রেগুলার চেকাপে যেতে চেয়েছেন ডাক্তারের চেম্বারে। খবর নিয়ে জানা গেল, উনি যে ডাক্তারের কাছে প্রায়শই চেকাপ করাতেন তিনি আর চেম্বারে বসেন না। করোনাকালীন ঝুঁকি এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত। তবু মনোয়ার সাহেবের ছেলেরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তিন দিনের মধ্যেও তারা চেকাপের জন্য কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেনি। বুকের ব্যাথা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত তাকে নিয়ে ছেলেরা রওনা দিল নিকটস্থ নামীদামী হাসপাতালে। কিন্তু বিধিবাম! করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ছাড়া কোনো রোগীর ভর্তি নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, কোভিড-১৯ এর কোনো লক্ষণ আছে বা করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া রোগী ভর্তি নিলে তাদের হাসপাতালে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।
দৃশ্যপট-২: রিতা বেগম (ছদ্মনাম), বয়স ৬৫। ক’দিন থেকে জ্বর-শ্বাসকষ্টসহ কিছু লক্ষণে ভোগায় ধারণা করলেন, শরীরে হয়তো বাসা বেধেছে করোনা নামক ভাইরাস। ছেলে-মেয়েরা সাধারণভাবে ঘরোয়া চিকিৎসা দেয়া ছাড়া কোনো পদক্ষেপই নিতে পারছে না। কেননা করোনা ডেডিকেটেডেট হাসপাতালে ভর্তির জন্য লাগবে ‘করোনা পজেটিভ’ রিপোর্ট। আর অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তির জন্য লাগবে ‘করোনা নেগেটিভ’ রিপোর্ট। শরীর একদম না কুলালেও বাধ্য হয়ে ভোরবেলা রাস্তা থেকে ডেকে আনা অটোরিকশাতে করে ছেলে আর নাতীসহ রওয়ানা দিলেন করোনা পরীক্ষার করার উদ্দ্যেশ্যে একটা হাসপাতালে।
হাসপাতাল(!) জনজীবনে অসুস্থ মানুষের সেবা দেয়ার উদ্দ্যেশ্যেই তৈরি হয়। সেখানে কর্মরত সকলেই মানবসেবায় নিয়োজিত। ডাক্তার, নার্স, আয়া, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তা সকলেই এমন একটি সেবায় নিয়োজিত- যেখানে মূলত অসুস্থকে সুস্থ করার উদ্দ্যেশ্যেই কাজ করার ব্রত নিয়ে তাদের পথচলা। রিতা বেগমও অসুস্থতার মারাত্মক দিক অনুভব করার পর প্রয়োজনবোধ করলেন চিকিৎসার। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই করোনা পরীক্ষা হয়ে উঠলো অত্যাবশ্যক। ভোরেই সেই স্বনামধন্য হাসপাতালের বাইরে সিরিয়াল নিয়ে লাইনে অপেক্ষা করতে লাগলেন ছেলে আর নাতীসহ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকল সূর্যের প্রখরতাও। জ্বর আর বার্ধ্যক্যজনিত ক্লান্তি-হয়রানি, সাথে তীব্র গরম। হাঁসফাঁস করতে করতে একসময় জ্ঞান হারালেন রিতা বেগম। তীব্র রোদে হাসপাতালের বাইরেই মাটিতে গাছের ছায়ায় তাকে শুইয়ে মাথায় পানি দিচ্ছেন পাগলপ্রায় ছেলে। নাতী দৌড়ে হাসপাতালে ছুটে গেল একটু সাহায্যের প্রার্থনায়। বেশ অনেকক্ষণ পর একটা স্ট্রেচারসহ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখা গেলো নাতীকে। না,সাথে নেই কোনো কর্মী, আয়া এমনকি ডাক্তারও। হাসপাতালের সংজ্ঞা যেন বদলে গেলো একটি ছোট ভাইরাসের কাছে হার মেনে।
দৃশ্যপট-৩: মতি সাহেব বেশ বড় ব্যবসায়ী। লকডাউন এবং করোনার প্রভাবে তার ব্যবসা বেশ খারাপ যাছে। কয়েকদিন থেকে শরীরটাও বেশ ভালো যাচ্ছে না। তাছাড়া এই হীরক রাজার দেশে টাকা থাকলেও সেবা আদৌ কতটুক মিলবে তারও ভরসা নেই। সেসব চিন্তা করে তার দেশের সাথে বাইরের দেশের ফ্লাইট চালু হতেই সিদ্ধান্ত নিলেন লন্ডনে বড় মেয়ের কাছে পাড়ি জমাবেন। তবে এ প্রক্রিয়াটার জন্য প্রয়োজন করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট। এটা ছাড়া ভিসা পাওয়া যাবে না। মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যম থেকে যতটুকু ধারণা পেলেন তাতে উনি মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত, সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে যেসব পরীক্ষা হয় সেসব রীতিমতো হয়রানিমূলক। তাছাড়া রিপোর্ট পেতেও কতদিন লাগবে তা কেউই সঠিক বলতে পারে না। টাকার জোর যেহেতু আছেই, সাথে রয়েছে নিজের জীবনের মায়া। মিডিয়া মারফত সন্ধান পাওয়া রহিমের (ছদ্মনাম) কাছ থেকে ৮০০০ টাকার বিনিময়ে কিনে নিলেন করোনা নেগেটিভের ভুয়া রিপোর্ট।
দৃশ্যপট-৪: মানবসেবাই ব্রত- এই প্রতিপাদ্য মাথায় রেখে ডাক্তারী শিক্ষাগ্রহণ করেছেন আনোয়ার সাহেব। করোনাকালীন যেখানে বাকি সহকর্মীরা সেবা দিতে ভয় পেতেন নিজের এবং পরিবারের কথা চিন্তা করে, আনোয়ার সাহেব সেখানে তার স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন তার নৈতিক দ্বায়িত্বের কথা। জনমানুষের স্বার্থে নির্ভয়ে চালিয়ে যান তার চিকিৎস। ফলাফল- মাত্র ১৩ দিনের মাথায় শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি এবং ৫ দিন করোনার সাথে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন।
করোনার ক্রান্তিকালেও থেমে নেই দুর্নীতির দৌরাত্ম্য। সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ একটি সহায়তা বরাদ্দ দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলে দেখা যায় একেকটি পিপিইর (সুরক্ষাসামগ্রী) দাম ধরা হয় ৫০০০ টাকা এবং গগলসের দাম ৫০০০ টাকা। অথচ আদতে পিপিইর দাম সর্বোচ্চ ২০০০ এবং গগলসের দাম ১০০০ টাকা করে।
এগুলো ছাড়াও খুব সাধারণ কিছু দৃশ্যপটে রয়েছে “হাসপাতালের ব্যয়ভার গ্রহণে অসমর্থ হওয়ায় নবজাতককে রেখে পলায়ন, ডাক্তারের অসতর্কতার কারণে রোগীর মৃত্যু।” আরেক পিঠে রয়েছে “ডাক্তারকে আক্রমণ করে হত্যা। রয়েছে নার্স কিংবা স্টাফ দ্বারা খারাপ ব্যবহার।”
স্বাস্থ্যখাতের মূল সমস্যা সমূহ
দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বাস্থ্যখাতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের উন্নয়নের কোনো রূপ ধারণা করা সম্ভব নয়। যে কোনো উন্নয়নশীল দেশই মূলত সবচেয়ে বেশি নজর দেয় দেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে। তবে এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়েই আছে বাংলাদেশ। প্রতি অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেটের কতটুকু আদতে ঠিকমতো ব্যয় হচ্ছে তার নেই কোনো সঠিক হিসাব। আবার সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দাবী- বরাদ্দকৃত বাজেটের বেশিরভাগই খরচ হয় বেতন-ভাতা (প্রায় ৪৭%), ঔষুধ এবং সার্জিক্যাল সাপ্লাই (৩০%)। আর বাকিটুকু ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণে। এক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে লালফিতার দৌড়াত্ব রয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া বাজেটের টাকা কোন্ খাতে কীভাবে কোথায় খরচ করতে হবে সেজন্য নেই কোনো দক্ষ জনবল। অনিয়ম আর দুর্নীতির তলে পড়ে ভঙ্গুরপ্রায় স্বাস্থ্যখাত।
মূলত যে কোনো হাসপাতাল নির্মাণ বা এ সংক্রান্ত কাজে নেয়া হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা। একজন ঠিকাদার নিশ্চই জানবেন না একটা হাসপাতাল কিভাবে সাজালে রোগীরা সর্বোচ্চ সেবাটুকু পাবে। তাছাড়া ১০০ টাকা খরচে কাগজে দেখানো হয় ৫০০ টাকা। মূলত দুর্নীতির লোভেই এসব ক্ষেত্রে কোনো যোগ্য এবং দক্ষ কর্মীকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয় না।
করোনার ক্রান্তিকালেও থেমে নেই দুর্নীতির দৌরাত্ম্য। সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ একটি সহায়তা বরাদ্দ দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলে দেখা যায় একেকটি পিপিইর (সুরক্ষাসামগ্রী) দাম ধরা হয় ৫০০০ টাকা এবং গগলসের দাম ৫০০০ টাকা। অথচ আদতে পিপিইর দাম সর্বোচ্চ ২০০০ এবং গগলসের দাম ১০০০ টাকা করে। কোথায় যায় তাহলে ব্যয় তালিকায় বরাদ্দ দেখানো বাকি টাকাগুলো?
বাংলাদেশে যত জায়গায় জনসমাগম হয়ে থাকে এবং সেবামূলক যতগুলি খাত রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে। সাধারণ মানুষ নিতান্ত নিরুপায় না হলে সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে ভয় পায়। মূলত ‘দালাল কর্তৃক হয়রানী এবং পর্যাপ্ত সেবা না পাওয়ার কারণে’ উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত রোগীরা পারতপক্ষে সরকারি হাসপাতালে সেবাগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তার পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্নক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের হয়রানী, নোংরা পরিবেশ, খারাপ ব্যাবহারের অভিজ্ঞতা, অব্যবস্থাপনা।
করোনাকালীন সময়েও থেমে নেই দালালদের দৌরাত্ম্য। টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট পেতে ছূটতে হয় দালাল ধরতে। শর্তসাপেক্ষে ‘দুই থেকে পাঁচহাজার’ টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় রিপোর্টের হার্ডকপির তোলা ছবি, যেটা দিয়ে পরবর্তী চিকিৎসা চালানো হয়। শুধু তাই নয়, সরকারি হাসপাতালে মোট জনসংখ্যার মাথাপিছু শয্যা রয়েছে মাত্র ০.৮%। যার কারণে হাসপাতালে কেবিন ভাড়া বা ওয়ার্ডে বেড পেতে গেলে দালালদের পেছনে গুণতে হয় বেশ বড় অংকের টাকা। মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের একমাত্র ভরসা থাকে সরকারি হাসপাতালগুলো। এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে নামমাত্র মূল্যে আউটডোর চিকিৎসা গ্রহণ এবং নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সরকারিভাবে বিনামূল্যে বা নামেমাত্র মূল্যে পাওয়া।
কিন্তু তাই বলে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা জবাবদিহিতার কোনো জায়গা না থাকা এবং অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার কারণে এখানেও রয়েছে বাণিজ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এখানে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে থাকেন। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় একই সময়ে তারা অন্য কোনো প্রাইভেট চেম্বার কিংবা কোনো বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানে ব্যস্ত। এতে করে টাকা রোজগার যেমন বাড়ে, তেমনি ভোগান্তিও অনেক কমে যায়।
বিনামূল্যে ঔষধ দেয়ার নীতি থাকলেও, একটা সিন্ডিকেট তা আত্মসাৎ করে বিক্রি করে থাকে। সাধারণ ইন্টার্ন ডাক্তার বা ডিউটি ডাক্তারও নয় বরং অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসা চলে নার্স কখনো-বা ওয়ার্ডবয় দ্বারা। উপজেলা কিংবা কমিউনিটি হাসপাতালগুলোর অবস্থা থাকে আরো নাজেহাল। ডাক্তারের দেখা পাওয়াই বেশ দুষ্কর সেখানে।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এর আলোকে দেখা যায়, মূলনীতি হিসেবে রয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। তাছাড়া বাংলাদেশের উপযোগী স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা, ই-হেলথ, টেলিমেডিসিন সেবা গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এই স্বাস্থ্যনীতিতে। মানসম্মত সেবাপ্রদানের লক্ষ্য ২০২০ এ এসেও কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তবে সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে টেলিমেডিসিন সেবা বেশ উন্নত হয়েছে এবং নাগালের ভিতর পাওয়া যাচ্ছে। সরকারিভাবে বেশ কিছু ডাক্তার প্রতিমুহূর্তে ফোনকলের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য ধন্যবাদ সংশ্লিষ্টদের।
তাসফিয়া হক বুশরা
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]