তার বয়স দুমাস আগে ৮৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছেলে নেই , আছে চার মেয়ে ও স্ত্রী। তিন মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। বাকি এক মেয়ে আই.এ পড়ে, তার এখনো বিয়ে দিতে পারেননি।
১৯ মে, বৃহস্পতিবার, সকাল ৬:৩০ মিনিটে রাজধানী ঢাকার সদরঘাট থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজন রিকশাচালকদের মধ্যে চোখ পড়লো এক অশীতিপর বৃদ্ধের দিকে। অন্যকোনো চালকের সাথে আর কথা না বলেই চলে গেলাম সেই বৃদ্ধ রিকশা চালকের কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা! যাত্রাবাড়ী যাবেন? বললেন, হ্যাঁ। বললাম, ভাড়া কতো দিতে হবে? বললেন ১০০ টাকা দিয়েন। তখন আর কিছু না বলেই রিকশায় উঠি। উনি চালাতে শুরু করলেন, অন্যান্য চালকের সাথে মিল রেখে জোরে চালাতে চাইলেও পারছেন না। বললাম, চাচা আপনার জোরে চালাতে হবে না, আস্তে আস্তেই চালান, আমার কোনো তাড়া নেই।
কতটুকু যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার বাসা কোথায়? বললেন, দেশের বাড়ি মাদারীপুর, কিন্তু থাকি গেন্ডারিয়ায়। বৃদ্ধের চেহারা দেখে আর মুখের কথা শুনে যে কারোরই চোখে পানি চলে আসাটাই স্বাভাবিক। তার বয়স, ছেলে/মেয়ে, পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও এই বয়সেও রিকশা চালানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, তার বয়স দুমাস আগে ৮৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। তার ছেলে নেই , আছে চার মেয়ে ও স্ত্রী। তিন মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। বাকি এক মেয়ে আই.এ পড়ে, তার এখনো বিয়ে দিতে পারেননি।
পরে জিজ্ঞেস করি, মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার খরচ চালান কীভাবে? তিনি বললেন, যে তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, তাদের স্বামীদের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো না। তারপরও মাঝেমধ্যে ছোট মেয়ের পড়াশোনার খরচের জন্য তারা কিছু দেয়, কিন্তু তাতে কি আর হয়রে বাপ!! আমার তো সংসারও আছে। এরমধ্যে কোনো উপায় না পেয়ে বিশ হাজার টাকার একটা লোন নিয়েছি। সপ্তাহে ছয়শত টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। আজকেও আবার কিস্তির তারিখ। তারপর জানতে চাইলাম, দৈনিক আয় কত? কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, বাবারে, বয়স বেশি দেখে কেউ আমার রিকশায় উঠতে চায় না। আর আমিও সারাদিন গাড়ি চালাতে পারি না, একবেলা গাড়ি চালাই। যোহর নামাজের আগে বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকেই বাসায় চলে যাই। তাহলে এবার বুঝেন আয় আর কত?
কথাবার্তা বলার মধ্য দিয়েই পৌঁছালাম যাত্রাবাড়ী টনি টাওয়ারে। রিকশা থেকে নেমে তিনি ভাড়া যা চেয়েছেন, তাই দিলাম, সাথে এক সপ্তাহের কিস্তির টাকাও। নাস্তা করাতে চেয়েছিলাম। বললেন, না করবো না! সকালে নাস্তা করেই বাসা থেকে বের হই। টাকা পেয়ে, কষ্টের মাঝে প্রকৃত হাসি আর আনন্দ যে কী তাই দেখতে পেলাম ৮৮বছর বয়সের এ বৃদ্ধের মুখে। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন এবং আমার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।
“কোনো উপায় না পেয়ে বিশ হাজার টাকার একটা লোন নিয়েছি। সপ্তাহে ছয়শত টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। আজকেও আবার কিস্তির তারিখ। তারপর জানতে চাইলাম, দৈনিক আয় কত? কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, বাবারে, বয়স বেশি দেখে কেউ আমার রিকশায় উঠতে চায় না। আর আমিও সারাদিন গাড়ি চালাতে পারি না, একবেলা গাড়ি চালাই। যোহর নামাজের আগে বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকেই বাসায় চলে যাই। তাহলে এবার বুঝেন আয় আর কত?”
বৃদ্ধের এ আনন্দ ও প্রকৃত হাসি স্মরণ করিয়ে দিলো রাসুল (স:) এর হাদিস, “তাই উত্তম দান, যা দাতার নিকট সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।” পরে স্মৃতি হিসেবে তার সাথে একটি ছবি তুলতে চাইলে গলায় থাকা গামছাটি সরিয়ে সুন্দরভাবে দাঁড়ান। অতঃপর একটি ছবি তুলি, দোয়া চেয়ে বিদায় নেই।
প্রিয় পাঠক! বৃদ্ধ লোকটি সম্পর্কিত উপরোক্ত লিখাগুলো প্রকাশ আমি আমার পরিচিতির জন্য করিনি। করেছি শুধুমাত্র ৮৮ বছর বয়সেও যে এক অসহায় বাবা জীবনযুদ্ধ ও সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন, তা বোঝানোর জন্যই। মনে রাখবেন, সত্যিই একটি ভালো কাজ অনেকগুলো ভালো কাজের জন্ম দিতে পারে। ধন্যবাদ।
হাসনাইন আহমেদ হাওলাদার: সংবাদকর্মী, ঢাকা থেকে
ক্যাটাগরি: প্রধান খবর, শীর্ষ তিন
[sharethis-inline-buttons]