সমালোচনা সাহিত্যের প্রাণ। সমালোচনাহীন কোনো সাহিত্যকর্ম হতে পারে না। সৃষ্টিশীল শৈল্পিক সাহিত্যকর্মের জন্য সমালোচনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণধর্মী আলোচনার জন্য বিশেষ জ্ঞানের অভাব কাম্য নয়।
লেখকের উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধনে যথার্থ সমালোচনা অপরিহার্য। প্রশংসা ও আবেগমিশ্রিত গুণকীর্তন যেমন আলোচনা নয়, তেমনি নিন্দার্থক আলোচনাও সমালোচনা নয়। সমালোচনা শব্দটির বিস্তৃত রূপ হলো, সম+আলোচনা=সমালোচনা। প্রথমত ব্যক্তি বা বিষয়ের সৌন্দর্য্য উপস্থাপনে ইতিবাচক আলোচনা এবং ধীরে ধীরে রচনাকর্মটির ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পর্যালোচনার নামই সাহিত্যালোচনা বা সাহিত্য সমালোচনা।
কোলকাতা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ইংলিশ টু বাংলা অভিধানে Discuss শব্দটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, to talk or write about something seriously or formally (গভীরভাবে অথবা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু আলোচনা করা বা লেখা)। অর্থাৎ আলোচনার জন্য Seriously or Formally এ দু’টি শব্দের প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিদ্বান বক্তাগণের আলোচনায় এ দুটি গুণই অনুপস্থিত। উনারা প্রশংসা দিয়ে গভীরতাকে ঢেকে দিয়েছেন।
সুশীল সমাজের আলোচনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই, বিশেষ ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি সাদাসিধা আবেগধর্মী প্রশংসা কিংবা বিচারবোধহীন নিন্দার্থক আলোচনা। বিচারবোধহীন প্রশংসা একজন লেখকের জন্য আফিমতুল্য। এ সম্পর্কে বহুবিদ্যাজ্ঞ রাজনৈতিক চিত্রকর্মকার লেখক এবং আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা Benjamin Franklin সার কথা বলেছেন, “অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় প্রশংসার।” উক্তিটির যথার্থতা আমাদের দেশে বিদ্যমান।
তৈলাক্ত বক্তব্যের দ্বারা দীর্ঘ দিন শ্রোতাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখা যায় না। বিচারবোধসম্পন্ন শ্রুতাগণ তাদের জ্ঞান-গরিমার গভীরতা বুঝতে পারেন। প্রশংসাসূচক কিছু বাক্য আওড়ানোর নাম আলোচনাই নয়, সমালোচনা তো নয়ই।
রাজনীতি কিংবা খেলাধুলা, সাহিত্য কিংবা ব্যবসায়, চাকুরী কিংবা কুটনীতি সর্বত্রই প্রশংসার বিনিময়ে স্বার্থ হাসিলের অসুস্থ প্রবণতায় টইটুম্বুর একবিংশ শতাব্দির বাংলাদেশ। মনে হয় আমাদের আলোচকগণ জর্জ নিন নেইথেন এর এই উক্তিটি খুব ভাল করে জানেন, ‘তুমি যত ভালো আর সৎ সমালোচক হবে তোমার সৎকার অনুষ্ঠানে লোকে তত কম ফুল পাঠাবে।’ তাই উনারা জনহিতকর শ্রমলব্ধ আলোচনার পরিবর্তে জনপ্রীতির অভিলাষে শ্রমহীন বক্তব্যের দ্বারা পাঠকদের বিভ্রান্ত করছেন।
সমালোচনা সাহিত্যের প্রাণ। সমালোচনাহীন কোনো সাহিত্যকর্ম হতে পারে না। সৃষ্টিশীল শৈল্পিক সাহিত্যকর্মের জন্য সমালোচনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণধর্মী আলোচনার জন্য বিশেষ জ্ঞানের অভাব কাম্য নয়। তৈলাক্ত বক্তব্যের দ্বারা দীর্ঘ দিন শ্রোতাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখা যায় না। বিচারবোধসম্পন্ন শ্রোতাগণ তাদের জ্ঞান-গরিমার গভীরতা বুঝতে পারেন। প্রশংসাসূচক কিছু বাক্য আওড়ানোর নাম আলোচনাই নয়, সমালোচনা তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, প্রশংসার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সমালোচনা করার জন্য প্রয়োজন নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গভীর অধ্যয়ন। তিনি আরো বলেন, ‘যথার্থ সমালোচনা’ মানে পূঁজা নয়। পূঁজায় শ্রদ্ধা থাকতে পারে, অন্ধ বিশ্বাসও থাকতে পারে, কিন্তু পূঁজায় বিচারবোধ থাকে না। যে সমালোচক পূজার আবেগমিশ্রিত ব্যাখ্যাকেই সমালোচনা মনে করেন, তাঁর কাছে সমালোচনা ব্যক্তি বিশেষের স্তুতি মাত্র।
শুধুমাত্র সামাজিক সম্পর্কের কারণে একজন আলোচক কাউকে বাহবা দিয়ে মেকি সার্থকতার আসনে বসাবেন না। আবার সংকীর্ণ সমালোচনার দ্বারা তাকে নিরুৎসাহিতও করবেন না।
শ্রদ্ধেয় বাগ্মীদের জ্ঞাতার্থে একজন সাধারণ শ্রোতা হিসেবে বলব, সাধারণ মানুষ অাশা করে, বক্তাগণ যুক্তিপূর্ণভাবে কাজের সমর্থন ও ক্ষেত্রবিশেষে সমালোচনা করবেন। কিন্তু যখন দেখি তাদের কেউ কেউ লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সর্বক্ষেত্রেই আন্তরিক সমর্থন দেন, এর পক্ষে বিভিন্ন বিশ্লেষণ বের করেন, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। আলোচককে প্রশংসার পাশাপাশি গঠনমূলক সমালোচনাও করতে হয়। সমালোচক একজন দক্ষ মালির মতো। যিনি সাহিত্যের বাগানে আগাছা বাছাই এর কাজ করে থাকেন। আগাছা বাছাই করতে করতে মূল গাছটি উপড়ে ফেলা যেমন তাক কাজ নয়, তেমনি অতিরিক্ত প্রশংসা দ্বারা আগাছাকে গাছে রূপান্তর করাও ঠিক নয়।
লেখকের সব লেখা
আমি সাহিত্যকে একটি ঘরের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। একটি ঘর কাঁচা হতে পারে, আধা পাকা হতে পারে, আবার পুরো পাকাও হতে পারে। নির্ভর করে মালিকের সামর্থের উপর। পাকা ঘরে যেমন সুখ চিরস্থায়ী হয় না, দুঃখও থাকে; তেমনি কাঁচা ঘরেও সুখ-দুঃখের মিশ্রণ আছে। তাছাড়া উভয় ঘরের বাস্তবতাই জীবনে বৈচিত্র আনে। একইভাবে দুর্বল সাহিত্যেও সুন্দর-অসুন্দর গলাগলি করে থাকে। তাকে আলাদা করেই বিবেচনা করতে হবে।
শুধুমাত্র সামাজিক সম্পর্কের কারণে একজন আলোচক কাউকে বাহবা দিয়ে মেকি সার্থকতার আসনে বসাবেন না। আবার সংকীর্ণ সমালোচনার দ্বারা তাকে নিরুৎসাহিতও করবেন না। তাই একজন সমালোচককে হতে হবে উদার, মুক্তমনা, অধ্যবসায়ী এবং সকল প্রকার সংকীর্ণ চেতনার ঊর্ধ্বে। কারণ তিনি তার গঠনমূলক সমালোচনার দ্বারা হয়ে উঠতে পারেন সাহিত্যিকগণের সঞ্জীবনী শক্তি। পাশাপাশি নবীন পাঠকও তার সৃজনশীল আলোচনার দ্বারা উপকৃত হবে।
মনির আবু মাহাথির : শিক্ষক ও সমাজকর্মী
ক্যাটাগরি: মিনি কলাম
[sharethis-inline-buttons]
সুন্দর ও যুক্তি সংগত ☺