মানবসমাজে জাতি ও সম্প্রদায়গত বিরোধের যে কয়টি কারণ বিদ্যমান, ‘শ্রেষ্ঠত্ব’র দাবী সেগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান। শক্তি ও ক্ষমতার মদমত্ততা, ধন, জন ও বিত্তের বিপুলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রাধান্য, বর্ণ, ধর্ম ও ধর্ম প্রবর্তককে নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করে থাকে অধিকাংশ মানুষ।
এই প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সকলেই অনমনীয়। বিনয় নম্রতা অথবা যুক্তির ধার ধারে না কেউ। ঘটা করে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটায় যখন তখন। মানবতাই সর্বোৎকৃষ্ট। এ-আপ্তবাক্য শোনা, বোঝা ও উপলব্ধির দরকার নেই। মনে হয়- বাণী দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারাটাই যথার্থ কাজ। এর ভিত্তিতে বিরাট সংখ্যক মানুষের মনে অহঙ্কারের বীজ রোপিত হয়, নিজেদেরকে এরা পৃথক ভাবতে শুরু করে। যা থেকে সূত্রপাত ঘটে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বৈরীতার।
ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জাতিতে জাতিতে প্রকাশ্যে ও গোপনে দূরত্ব ও সঙ্কট বৃদ্ধি পায়। মানুষে মানুষে মৈত্রী সম্প্রীতি লোপ পেতে থাকে। মানুষ তো মানুষেরই অংশ, বন্ধু, স্বজন তবুও অনন্ত অতীত থেকে সাম্প্রতিক কাল, সব কালেই তা ছিল। চন্দ্র মঙ্গল বিজয়ী, মহাসমুদ্রের গভীর তলদেশে অভিযান চালানো মানুষ তার অন্তরে মজ্জায় বহন করে আনা হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধকে জয় করতে পারেনি।
জন্মসূত্রে মানুষ বোধ বুদ্ধি ও চেতনার সঙ্গে হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধ নিয়ে জন্মায়। এগুলোর ক্রমাগত চর্চা মানুষের প্রধানতম গুণ মনুষত্বের বিকাশকে রুদ্ধ করে। খনি হতে আহরিত আকরিক পদার্থ যেরূপ শোধনহীন ব্যবহার অনুপযোগি, হিংসা, দ্বেষ ও ক্রোধাশ্রিত মানুষও তেমনি অবিকশিত বিবেচনাহীন অসামাজিক ও অমানুষ হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন> অসার জীবনে চাই তাৎপর্যপূর্ণতা
আকরিক পদার্থকে পুড়িয়ে গলিয়ে ঘষামাজা অথবা পরিশোধন সাপেক্ষে ব্যবহার করা যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন পদার্থই শোধিত হয় না। তেমনি মানুষকে তার বোধ বুদ্ধি ও চেতনার সাহায্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। অথচ শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারে মানুষ তা পেরে ওঠে না। ফলে এসকল বদগুণের পরিবর্তন করতে পারছে না বিপুল সংখ্যক মানুষ।
এতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে মানবজাতি। তাই পৃথিবীব্যাপী উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটছে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রেষ্ঠত্বের অন্ধ অহঙ্কারে মানবসমাজ আজ আত্মবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে নাকি? মনে রাখা আবশ্যক অহঙ্কারী ও মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার নেতৃত্ব যে কোন ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। যা আণবিক বোমার বিষ্ফোরণ থেকেও হতে পারে ভয়ঙ্কর। কারণ শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার এদেরকে অপরিণামদর্শী করে তোলে। সুতরাং এটি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
লেখকের সব লেখা
মোজাম্মেল হক: চিন্ত্যক, কলামিস্ট
ক্যাটাগরি: মিনি কলাম
[sharethis-inline-buttons]