বাংলাদেশ রেলওয়ের এই মেগা প্রকল্পের কাজ কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে ঢাকা-চট্রগ্রাম রোডে রেলভ্রমণ যাত্রীদের জন্যে আরামদায়ক হবে। সময়ও আগের চেয়ে অনেক কম লাগবে।
যাত্রী সাধারণের সুবিধার্থে প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করে চলেছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও ফেলেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হলেও লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন উন্নয়নকরণ প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি! এই মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্রগ্রাম রেললাইনের পুরোটাই ডাবল লাইন হয়ে যাবে।
সময় বাড়িয়েও ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পের কাজ কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, করোনা মহামারির প্রভাবে এবং অনেকক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সময়ক্ষেপনের কারণে সময় বাড়িয়েও শেষ হচ্ছে না এ প্রকল্পের কাজ। ফলে আরও একদফা এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে প্রকল্প এলকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এই মেগা প্রকল্পের কাজ ঢিমেতালে চলছে। কোথাও কোনো প্রাণোচ্ছ্বলতা নেই।
এই প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আখাউড়া রেলওয়ের সহকারী-নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসানের দপ্তরে গেলে তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে তার দপ্তরের প্রধান অফিস সহকারী ইস্রাফিল মিয়ার কাছ থেকে জানা যায়, লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পের দীর্ঘ ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইনের মধ্যে লাকসাম-কুমিল্লার ২৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে এবং চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর উক্ত পথ চলাচলের জন্যে খুলে দেওয়া হবে। এর উদ্বোধন করবেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।
দপ্তরে উপস্থিত আখাউড়া রেলওয়ের সাবেক উপ সহকারী-প্রকৌশলী রেনু মিয়া বলেন, কুমিল্লা থেকে লাকসাম পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন চালু হলে সিগন্যালের কোনো বাধা ছাড়াই ট্রেন চলতে পারবে। ট্রেন অপারেশনে আগের ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় কমে যাবে। তা ছাড়া আলিশহর, লালমাই ও ময়নামতি রেলস্টেশন দিয়ে আসা বিপরীতমুখী ট্রেনকে সাইড দিতে গিয়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না কোনো ট্রেনকে।
প্রকল্পের সুপারভাইজারের কাছ থেকে জানা যায়, প্রকল্পের কাজ চলতি বছরে শেষ করার কথা ছিল। তবে করোনা, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও প্রকল্পের কিছু জায়গার মাটিকে ব্যবহার উপযোগীসহ বিভিন্ন জটিলতায় সময়মতো কাজ শেষ হয়নি। এ কারণে বেড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ। ২০২৩ সালের জুনে ৭২ কিলোমিটার রেললাইনের পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে কুমিল্লা-আখাউড়া পর্যন্ত বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, ডাবল লাইন স্থাপনের কাজ বিভিন্ন স্টেশনভিত্তিক হচ্ছে। তবে প্রকল্পের কর্মীদের মধ্যে কর্মোচ্ছ্বলতা তেমন নেই।
প্রকল্প প্রসঙ্গে গঙ্গাসাগর স্টেশন মাস্টার মোঃ নাজিম উদ্দিন বলেন, রেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্রগ্রাম রুটটি ডাবল লাইন হয়ে গেলে শুধু ট্রেনের গতিই বাড়বে না, বাড়নো যাবে ট্রেনের সংখ্যাও। কোনো কারণে একটি লাইনে দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য লাইনে ট্রেন চালানো যাবে।
তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিক সময়ে এই রেললাইন দিয়ে দিনে ২৩টি ট্রেন চলাচল করে। ডাবল লাইন হলে এই রুটে ৭২টি পর্যন্ত ট্রেন চালানো যাবে। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন পাশে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক সিনিয়র লোকো মাস্টার মোঃ বাবু মিয়া। একসময় তিনি আখাউড়া এলাকায় চাকরি করতেন। এখানে বেড়াতে এসেছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা শহরে বসবাস করেন।
উল্লেখ্য, রেলপথে ঢাকা-চট্রগ্রাম দূরত্ব ৩২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৮ কিলোমিটার ডাবল লাইন অনেক আগেই করা হয়েছিল। ২০০৮ সাল থেকে সরকার অবশিষ্ট রেল লাইনকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার কাজ শুরু করে। ২০১১ সালে টঙ্গি-ভৈরববাজার পথে ৬৪ কিলোমিটার এবং লাকসাম-চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার ডাবল লাইন স্থাপনের কাজ শেষ করা হয়। এখন লাকসাম-আখাউড়া ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হওযার পর এই পথে আর কোনো ক্রসিং থাকবে না। ফলে চলার পথে কোথাও থামতে হবে না। দুই লাইনে এক সঙ্গে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটারাইজড সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ ১৩টি রেলস্টেশন আধুনিকায়ন ও ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ চলছে। বড় সেতুসহ মোট ৪৬টি ছোট-বড় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে।
চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, বাংলাদেশের তমা কনষ্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাষ্ট্রাকচার যৌথভাবে এ প্রকল্পে কাজ করছে।
আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন নির্মাণে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে এডিবি ঋণ দিচ্ছে ৪ হাজার ১১৮ কোটি ১৪ লাখ এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) দিচ্ছে ১ হাজার ৩৫৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাকি ১ হাজার ২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।
অভিজ্ঞমহলের অভিমত, বাংলাদেশ রেলওয়ের এই মেগা প্রকল্পের কাজ কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে ঢাকা-চট্রগ্রাম রোডে রেলভ্রমণ যাত্রীদের জন্যে আরামদায়ক হবে। সময়ও আগের চেয়ে অনেক কম লাগবে।
খায়রুল আকরাম খান: ব্যুরো চীফ
ক্যাটাগরি: প্রধান খবর, শীর্ষ তিন
[sharethis-inline-buttons]