বৃহস্পতিবার বিকাল ৩:১০, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

মানুষের ধর্ম চিহ্নিত হোক

জাকির মাহদিন

কারণ মানুষ অন্যান্য সৃষ্টি থেকে স্বতন্ত্র। মানুষ অসীম চাহিদার অধিকারী। শারীরিক অনন্য গঠনের সঙ্গে মানসিক ক্ষমতা ও বাক-বুদ্ধি-চিন্তা-দর্শন মিলে মানুষের যে সম্ভাব্য ক্ষমতা সেটা খারাপ ভালো দুদিকেই প্রবল শক্তিধর। তাছাড়া মানুষের চাহিদা কেবল জৈবিক নয়, মানসিকও। তাই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি ছাড়া মানুষের জন্য বিকল্প নেই।

ধর্ম নিয়ে আজকাল কিছু বলতে গেলে বড়বেশি ভাবতে হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশে। কারণ এক্ষেত্রে প্রায় সবাই এখন দুটো ‘শ্রেণিগত ধারণায়’ বিভক্ত। হয় আপনি আস্তিক, নয়তো নাস্তিক। মাঝামাঝি (বিশেষ অর্থে) থাকা মানে চুপ। কথা বললে আপনাকে নিজ থেকেই একটা পক্ষ নিতে হবে, অথবা অন্যরা কোনো এক পক্ষে ঠেলে দেবে। তারপরও যদি কেউ সাহস করে মুখ খুলে, তবে সে উভয়ের ‘টার্গেটে’ পরিণত হবে।

নাস্তিকরা যেহেতু মনে করে ধর্মে (ইসলাম) জঙ্গিবাদ আছে বলেই ধর্মের নামে এসব হত্যাকাণ্ড, সুতরাং কেউ যদি বলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মে এসব নেই, যারা করছে তারা ভুল করছে, তাহলে তাকে আমরা যথাসম্ভব থামিয়ে রাখব। কোনো ফ্লোর দেব না বা স্পেইস দেব না। কোনোভাবেই প্রচার হতে দেব না। কারণ তার দ্বারা ধর্মকে সমূলে উৎপাটন করার আমাদের ‘মিশন’ বাধাগ্রস্ত হবে। যে ধার্মিক সে আর যাই হোক, মানবিক হতে পারে না। ধর্ম আর মানবতা একসঙ্গে চলতে পারে না।

তাদের দৃষ্টিতে আজকের পৃথিবীর প্রধান সমস্যা ধর্ম। ধর্ম মানেই উগ্রতা, জঙ্গীবাদ। বাকস্বাধীনতা ও নারীস্বাধীনতার চরম বিরোধী। আল্লাহ-রসুলে বিশ্বাস মানেই বিজ্ঞানবিরোধী, নির্বোধ। তারা আফসোস করেন যে লোকটা এতকিছু বোঝে, কিন্তু ধর্ম থেকে বের হতে পারল না! আর আস্তিকরা মনে করে সে ধর্মকে ভুলভাবে পেশ করছে। নাস্তিকদের কাছে আধুনিক সাজতে চেষ্টা করছে। আসলে সে নাস্তিক, মুরতাদ, মুনাফিক। এরা আফসোস করে যে কোরআন হাদিস পড়েও সে নাস্তিক হয়ে গেল! ইসলামের এত সৌন্দর্য বুঝল না?

যে বিষয়টি প্রথমেই আলোচনায় আনতে হবে তা হলো, ধর্মের জাগতিক ও প্রকাশ্য দিকটা। এটা এমনকি ধর্মনিরপেক্ষভাবে অর্থাৎ ধর্মের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি ছাড়াও আলোচনা সম্ভব। শুধু তাই নয় বরং ধর্মের বাইরের বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা ধর্মকে বোঝার পূর্বশর্ত।

এরা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারে না যে এদের আচরণ, ধ্যান-জ্ঞান প্রচুর মানুষকে ধর্ম থেকে শুধু বিমুখই করছে না, চরম বিরোধীও করছে। অন্যদিকে আন্তর্ধর্মীয় ও আন্তঃধর্মীয় সংঘাত এবং বিভেদ-বিশৃঙ্খলা তো আছেই। কিন্তু একবারও আমরা ভাবি না, ধর্ম নিয়ে কেন এত বিতর্ক ও সংঘাত? কেন ধর্মে ধর্মে এত দূরত্ব, একই ধর্মে এত মত? আসলে মানুষের ধর্ম কী বা মানবধর্ম কী?

বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করতে হলে আরো পেছনে যেতে হবে। ধরুন আমরা প্রশ্ন রাখলাম, মানুষের ধর্ম অথবা ‘মানবিক ধর্ম’ কী। অথবা, মানুষের জন্য কি ধর্ম লাগবেই? ধর্ম ছাড়া মানুষের সমাজ ও জীবন চলতে পারে না? ঠিক এই প্রশ্নটাই যদি আমরা এভাবে করি, মানুষের জন্য কি নিয়ম-নীতি ও আইন-শৃঙ্খলা লাগবেই, এর বিকল্প নেই? উত্তর হবে- না, নেই। কেন নেই? কারণ মানুষ অন্যান্য সৃষ্টি থেকে স্বতন্ত্র। মানুষ অসীম চাহিদার অধিকারী। শারীরিক অনন্য গঠনের সঙ্গে মানসিক ক্ষমতা ও বাক-বুদ্ধি-চিন্তা-দর্শন মিলে মানুষের যে সম্ভাব্য ক্ষমতা সেটা খারাপ ভালো দুদিকেই প্রবল শক্তিধর। তাছাড়া মানুষের চাহিদা কেবল জৈবিক নয়, মানসিকও। তাই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি ছাড়া মানুষের জন্য বিকল্প নেই।

আসলে মানব সমাজের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিতর্ক হচ্ছে ‘মানব জীবনের’ নিয়ম-নীতি ও বিধি-নিষেধ নিয়ে, বিশেষত যার উৎস অলৌকিক, বুদ্ধিবহিভর্‚ত। এই অলৌকিক আল্লাহ-রসুল ও বেহেশত-দোযখ নিয়ে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে কোনোই সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না, সম্ভবও নয়। অন্যদিকে ধর্মীয় বিধিনিষেধগুলো চ‚ড়ান্ত পরীক্ষায় অসীম উপকারী প্রমাণিত হলেও আপাতদৃষ্টিতে মানবিক প্রবৃত্তির চরম বিরোধী। তাই ধর্ম নিয়ে আমাদের এত বাদানুবাদ, বিতর্ক, সংশয়। সুতরাং এখানে যে বিষয়টি প্রথমেই আলোচনায় আনতে হবে তা হলো, ধর্মের জাগতিক ও প্রকাশ্য দিকটা। এটা এমনকি ধর্মনিরপেক্ষভাবে অর্থাৎ ধর্মের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি ছাড়াও আলোচনা সম্ভব। শুধু তাই নয় বরং ধর্মের বাইরের বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা ধর্মকে বোঝার পূর্বশর্ত।

ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম? আমি মনে করি মানুষের জন্যই ধর্ম। তবে এর অর্থ এই নয় যে মানুষের দ্বারা ধর্ম উপকৃত হবে। ধর্ম অবস্তুগত, সুতরাং বস্তুর প্রতি অমুখাপেক্ষি। মানুষ তার প্রয়োজনে ধর্ম মানবে বা পালন করবে। কেউ করতে না চাইলে তাকে ধর্ম বাধা দেয় না, কেবল সমাজের স্বাভাবিক শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে। ধর্মের দাবি- ধর্ম ছাড়া মানুষের জন্য শান্তি-শৃঙ্খলার দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

সমসাময়িক সমাজ, পরিবেশ, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, আইন, মানবিক জীবনের চাহিদা ও গতিপ্রকৃতি, সমসাময়িক সমস্যার মাত্রা ও ধরনই হতে পারে আপাতত আমাদের আলোচনার বিষয়। যে মানুষ (পশু অথবা ফেরেশতা নয়), তাকে মানুষের গুণ, জ্ঞান, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, সামর্থ্য ও বোধের জায়গাটি থেকেই ধর্মকে বুঝতে হবে বা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সরাসরি ধর্মের অলৌকিক দিকগুলো বোঝা, উপলব্ধি করা এমনকি পর্যালোচনার পথটি পর্যন্ত আজ খোলা আছে বলে আমার জানা নেই। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা ছাড়া আল্লাহ-রাসুলের আলোচনা অধিকাংশ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর ঠেকে। আবার যাদের সচরাচর বিচরণ ধর্মের বাইরের বিষয়েই এবং বহুবছর ধরেই, তারা মনে করতে পারেন ওসব শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু তখন প্রশ্ন হবে, সেসব থেকে সমস্যার মূল উৎস ও আলোচনার বিষয়বস্তু কী কী চিহ্নিত করেছেন এবং বিপরীত মত-মন্তব্য কতটুকু নিয়েছেন? সবশেষে উন্মুক্ত বৈঠক আহ্বান ও চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে কি? না এই প্রাথমিক শর্তের শিখরটিই আমরা আজো পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারিনি?

ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম? আমি মনে করি মানুষের জন্যই ধর্ম। তবে এর অর্থ এই নয় যে মানুষের দ্বারা ধর্ম উপকৃত হবে। ধর্ম অবস্তুগত, সুতরাং বস্তুর প্রতি অমুখাপেক্ষি। মানুষ তার প্রয়োজনে ধর্ম মানবে বা পালন করবে। কেউ করতে না চাইলে তাকে ধর্ম বাধা দেয় না, কেবল সমাজের স্বাভাবিক শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে। ধর্মের দাবি- ধর্ম ছাড়া মানুষের জন্য শান্তি-শৃঙ্খলার দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। কিন্তু আসলেই এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ আছে কি না সেটা খোঁজাখুঁজি করতে ধর্ম কোনোরকম বাধা তো দেয়ই না বরং প্রচণ্ভাডবে উৎসাহিত করে।

ধর্ম অনেক কিছুই দাবি করে, যার অর্ধেক বা অধিকাংশ বা মূল বিষয়গুলো অলৌকিক। মানবিক বুদ্ধি-কল্পনাবহির্ভূত। কিন্তু এর বাইরের বিষয়গুলো একেবারেই জাগতিক, সহজবোধ্য। সাধারণ বিচার-বুদ্ধি দিয়েও বোঝা এবং পার্থক্য করা যায়। মূলত মানুষের জীবনের সহজ সাধারণ বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই ধর্মের আবির্ভাব এবং বিরতিহীন যাত্রা।

অবশ্য যে কোনো দিক থেকে যে কোনো বিষয় দিয়েই ব্যক্তিগত চিন্তা অথবা সামষ্টিক পর্যালোচনা শুরু করা হোক, পরিশেষে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধর্ম এবং বিশ্বাসের প্রশ্নটি আসেই। এর কারণও সহজবোধ্য। কিন্তু যতক্ষণ সম্ভব সেটি এড়িয়ে চললে এবং বাইরের বিষয়গুলো সর্বোচ্চ মাত্রায় পর্যালোচনা করা সম্ভব হলে ধর্ম ও বিশ্বাস নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্ক এমনিতেই মীমাংসা হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। তাই যারা ধর্মের খাঁটি অনুসারী, তাদের গোড়ামীর কোনো প্রয়োজন নেই। ধর্ম ধর্ম করে রব তোলা বা এ বিষয়েই আটকে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং যতবেশি সম্ভব এর বাইরের ও বিপরীত দিকগুলো দেখার, বোঝার এবং আলোচনার চেষ্টা করতে হবে।

ধর্ম শুধু কতগুলো আদেশ-নিষেধের নামই নয়, এটি একটি জীবন দর্শন। মানুষের সবকিছুর মূলে তার জীবন। এই জীবনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ ও বোধ জাগ্রত করে ধর্ম। ধর্মের সুগভীর তাত্তি¡ক ও দার্শনিক ভিত্তি আছে। সেই ভিত্তিগুলো অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনে ভিন্নমতের দিক থেকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া মানবিক ধ্বংসাত্মক বিতর্কের অবসান সম্ভব নয়।

জাকির মাহদিন : সম্পাদক, দেশ দর্শন

zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply