‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ সে দিনটি আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাঙালি ও বাংলা ভাষা আজ আর এক বা দুটি ভূখণ্ডের সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। বাংলা ভাষা বিশ্বের ত্রিশ কোটি মানুষের ভাষা।
ইতর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নির্ণয়ের অন্যতম একটি প্রধান উপায় হলো ভাষা। আর মাতৃভাষার মাপকাঠিতে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উন্নতি-সমৃদ্ধিও পরিমাপ করা হয়। মায়ের বুকের দুধ যেমন শিশুকে হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ করে, তেমনি মাতৃভাষাও একটি জাতিকে ন্যায়নীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাসসহ সমস্ত মৌলিক বিষয়গুলো পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত ও সমৃদ্ধ, সে জাতি তত শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য।
বাঙালি হিসেবে আমরা এমনই এক ভাষার অধিকারী, যার রয়েছে সুদীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব বাংলা, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে মিলে স্বাধীন পাকিস্তান গঠিত হয়। এক সময় স্পষ্ট হয়ে উঠে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলার বন্ধু নয় বরং শাসক হিসেবে শোষণ করছে। বাঙালির সংস্কৃতি ও অন্যান্য সবকিছুর প্রতি বৈরিতার প্রথম প্রকাশ আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলাকে কেন্দ্র করেই। ১৯৪৭ সালে বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার বিষয়ে এত ব্যাপক মতৈক্য হয়েছিল যে সরকারের মন্ত্রী, গণপরিষেদের সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, পুলিশের আইজি, সকরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী সকলের দাবি ছিল একটিই- প্রদেশগুলিতেও বাংলা ভাষা চালু হোক।
ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসাবে বাংলা পৃথিবীর অষ্টম ভাষা। যেখানে বাঙালি, সেখানেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সীমিত পরিসরে হলেও আপন অস্তিত্বে স্পন্দমান; বিকশিত। এ সুখানুভূতির পাশাপাশি আজ বেড়েছে আমাদের দায়িত্ববোধের ব্যাপ্তিও। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বিধাহীন চিত্তে লালন, চর্চা ও পরিচর্যার গুরু দায়িত্ব।
তারপর বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন, ১৯৫২ সালের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ’৫৪-তে গণপরিষদে প্রস্তাব পাস, ’৫৬-তে শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দান বাঙালি মানসে রোপন করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের বীজ, যা মহিরূহে পরিণত হয় ১৯৭১-এ।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মত্যাগের এ বিরল ঘটনা বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিকে অধিষ্ঠিত করে এক অত্যুচ্চ মর্যাদায়। এরই ফলশ্রুতিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ সে দিনটি আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাঙালি ও বাংলা ভাষা আজ আর এক বা দুটি ভূখণ্ডের সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। বাংলা ভাষা বিশ্বের ত্রিশ কোটি মানুষের ভাষা। দেশ বিভাগের পূর্বে শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বাংলা ‘দেশভাষা’ রূপে প্রচলিত ছিল। ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসাবে বাংলা পৃথিবীর অষ্টম ভাষা। যেখানে বাঙালি সেখানেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সীমিত পরিসরে হলেও আপন অস্তিত্বে স্পন্দমান; বিকশিত। এ সুখানুভূতির পাশাপাশি আজ বেড়েছে আমাদের দায়িত্ববোধের ব্যাপ্তিও। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বিধাহীন চিত্তে লালন, চর্চা ও পরিচর্যার গুরু দায়িত্ব।
আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মনোভাব নতুন করে স্থির করতে হবে- ভাষার মাসে আমাদের এই হোক প্রত্যয়।
তবু আমাদের মাঝে রয়েছে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বাঙলা ভাষা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রচলনে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত। সারাদেশের মানুষকে বাংলার অক্ষরজ্ঞান দান করতে পারছি না। অথচ প্রাথমিক স্তর থেকে বাংলার সাথে ইংরেজি পড়তে হয়। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি জানলে বুঝলে পড়লে নিশ্চয় আমরা লাভবান হবো। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবো। তবে তার আগে তো নিজের অস্তিত্বের ভাষা, প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষায় দেশবাসীকে শিক্ষিত করতে হবে।
আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মনোভাব নতুন করে স্থির করতে হবে- ভাষার মাসে আমাদের এই হোক প্রত্যয়।
লিটন হোসাইন জিহাদ : সম্পাদক- পথিকনিউজ ডটকম
mjihad38@yahoo.com
ক্যাটাগরি: মিনি কলাম
[sharethis-inline-buttons]