সময়টা তখন ওয়ান/এলিভেনের। সে সময় ঢাকার একটি প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিকে এবং স্থানীয় একটি পত্রিকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খালের বিউটিফিকেশন প্রজেক্ট নিয়ে দুটো বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমি তখন সেই স্থানীয় দৈনিকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই নড়েচড়ে বসে গোটা শহরবাসী। প্রতিদিনই শহরের কেউ না কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
আজকাল শহরের এখানে-সেখানে ব্যঙের ছাতার মতো বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পয়দা হওয়ায় একশ্রেণির দালাল সন্তান-সম্ভবা মুমূর্ষু মাকে অমুক-তমুক প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসার নামে নিয়ে যান বা যেতে পরমর্শ দিয়ে থাকেন। রোগী গেল আর ওমনি ওটিতে নিয়ে সরাসরি সিজার! দু’দিন বাদে কম করে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা গুণে গুণে দিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয় মা ও নবজাতককে। বেকায়দায় পড়েন তারা; যারা নরমাল ডেলিভারি চান। মায়েদের মাতৃত্বকালীন সময়কে স্থানীয়ভাবে নিদানকাল বলা হয়ে থাকে। ওই সময়টাতে একজন মা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকেন। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে মা ও নবজাতকের প্রাণহানির শংকা বেড়ে যায়। মূল কথা, যখন যা করার দরকার, তখন তাই করতে হয়। তাছাড়া প্রসবকালীন ব্যথা একজন মায়ের জন্যে কতটুকু বেদনাদায়ক- তা একমাত্র ভুক্তভোগীই হলফ করে বলতে পারেন। অবশ্য আজকাল বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মানুষের মন-মানসিকতার ভিন্নতা সৃষ্টির কারণে অনেকেই কাটা-ছেঁড়ার (সিজার) মাধ্যমে সন্তান জন্মদানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাই বলে যে সবাই এই প্রথাকে সমর্থন করেন- তা না।
এবার ভিন্ন দৃষ্টিতে সিজারের কাটা-ছেঁড়া নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। সময়টা তখন ওয়ান/এলিভেনের। সে সময় ঢাকার একটি প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিকে এবং স্থানীয় একটি পত্রিকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খালের বিউটিফিকেশন প্রজেক্ট নিয়ে দুটো বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমি তখন সেই স্থানীয় দৈনিকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই নড়েচড়ে বসে গোটা শহরবাসী। প্রতিদিনই শহরের কেউ না কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। শেষ পর্যন্ত শহরবাসীর প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক শহর খালের এই প্রকল্প নিয়ে একটি তদন্ত কমটি গঠন করেন। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ইমরুল চৌধুরী। ক’দিনের মধ্যে তিনি আমাকে ডেকে আমার লিখিত মতামত দিতে বলেন। মতামত নিয়েছেন শহরবাসীর অনেকেরই। আমি আমার মতামতে লিখে ছিলাম- ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খালের ব্যাস ও গভীরতা ঠিক রেখে যেন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিছুদিন পর পরিস্থিতি শান্ত হলে দেখা গেল, প্রকল্পের কাজ চলছে। ক’মাসের মধ্যে কাজ শেষও হল। প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল তৎকালীন সময়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা। অবশ্য কাজটি দু’ভাগে করা হয়েছিল। ফকিরাপুল ব্রীজ থেকে পূবদিকে তিতাস নদীর মোহনা পর্যন্ত একভাগ এবং অপর ভাগের কাজ হয়েছিল ফকিরাপুল ব্রীজের পশ্চিম দিকে। সে যাই হোক, দেখতে দেখতে এই ক’বছরে বিউটিফিকেশন প্রজেক্ট নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
এককালে প্রমত্তা তিতাসের পানি প্রবাহের একটি বিশাল ধারা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই টাউন খাল। উজানের নেমে আসা পাহাড়ি পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তৎকালীন তিতাস পুর্বাঞ্চলের বিলের ফসলকে রক্ষা করতো। দিনে দিনে পলি পড়ে তিতাসের নাব্যতা কমে গেলে ব্রিটিশের শেষ পাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার তিতাস পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১৮ মাইল দীর্ঘ বিলের ফসল ফি বছর বানের পানিতে তলিয়ে যেত। তখন এই টাউন খাল (শহর খাল) দিয়ে তীব্র বেগে পানি নেমে গেলেও পূর্বাঞ্চলের ফসল রক্ষা হতো না।
এদেশে এককালে সখ করে আনা কচুরিপানা জটাবেঁধে কয়েক হাত উঁচু হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খাল চলাচলের অযোগ্য হওয়া এবং ময়লা-আর্বজনা ভেসে যেতে বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় এক বছর আগে (২০১৮ এর মাঝামাঝির কথা বলছি) স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ভরা বর্ষায় কাচি দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে কচুরিপানা গোকর্ণঘাট এলাকা দিয়ে তিতাস নদীতে ভাসিয়ে এর পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়। ওই সময় থেকে এই খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা নিষেধ। কিন্তু কে শুনে কার কথা? অবশ্য হোটেলের ময়লা-আবর্জনা ফেলে ফেলে ফকিরাপুল পুরাতন ব্রীজের উত্তর দিকে উঁচু ঢিবির মত করলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ক্যাফে আব্দুল্লাহ হোটেলের মালিক বেচারা সেলিমকে দিয়ে পরিষ্কারও করিয়ে নেন। এর ক’দিন পরেই বর্ষার ভাটা পড়ে।
এককালে প্রমত্তা তিতাসের পানি প্রবাহের একটি বিশাল ধারা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই টাউন খাল। উজানের নেমে আসা পাহাড়ি পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তৎকালীন তিতাস পুর্বাঞ্চলের বিলের ফসলকে রক্ষা করতো। দিনে দিনে পলি পড়ে তিতাসের নাব্যতা কমে গেলে ব্রিটিশের শেষ পাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার তিতাস পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১৮ মাইল দীর্ঘ বিলের ফসল ফি বছর বানের পানিতে তলিয়ে যেত। তখন এই টাউন খাল (শহর খাল) দিয়ে তীব্র বেগে পানি নেমে গেলেও পূর্বাঞ্চলের ফসল রক্ষা হতো না। তখনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এম এন খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক হিসেবে যোগদান কারেন। যোগদানের পর তিনি তিতাস পূর্বাঞ্চলবাসীর (আজকের বিজয়নগর উপজেলা) দুঃখ দেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ওপর দিয়ে আরো একটি পানি প্রবাহের ধারা সৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতে সরকারি অর্থ না মিলায় তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্বেচ্ছাশ্রমে শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উলচা পাড়া হয়ে গোকর্ণঘাট তিতাসের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত খাল খনন করেন। যা এন্ডারসন বা কুরুলিয়া খাল নামে পরিচিত। একজন অবাঙালি হয়েও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে নিজ উদ্যোগে পানি প্রবাহের ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। আফসোস! আজ আমরা আমাদের সম্পদ ও সোৗন্দর্য় রক্ষায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই প্রাচীন খালটিকে গলাটিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছি। কিন্তু কেন? কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল আর ক’জন ভূমিগ্রাসকারীর জন্যে কি?
এ বছর এখনো পুরোপুরি বর্ষা আসেনি। সময় আছে আরো কয়েক মাস। ইতিমধ্যে সেই পুরনো চেহারা দেখা যাচ্ছে শহর খালের ওপর। একে তো বিউটি ফিকেশন প্রকল্পের পর শহর খালের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তার ওপর আবার ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। সর্বোপরি শহর খালের বাইপাস সড়কের পশ্চিমে এমনিতেই খালটির প্রশস্ততা কম, তার ওপর ওই দিকটিতেই খালের ব্যাসার্ধ কমিয়ে কে বা কারা একটি সড়ক পথ তৈরির ফলে খালের অস্তিত্ব পড়েছে হুমকির মুখে।
শহরের টানবাজার এলাকার তিতাস নদীর মোহনা থেকে গোকর্ণঘাট পর্যন্ত শহর খালের যে আকা-বাকা গতিধারা রয়েছে, এর বর্তমান হাল অবস্থা নিজ নয়নে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে, খালটি কতভাবে কত স্থানে এর গতিধারা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। খালের কোথায় কোথায় কতটুকু ব্যাসার্ধ ছিল, আর বর্তমানে কতটুকু আছে? অথচ এই খাল দিয়ে ক’বছর আগেও বর্ষা মৌসুমে শত শত নৌকাযাত্রী ও মালামাল পরিবহন করতো। থানা ঘাট থেকে টান বাজার পর্যন্ত পণ্যবাহী বিশাল বিশাল নৌকাগুলো সারিবদ্ধভাবে বাধা থাকতো। এই ক’বছরে শহর খালের এখানে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ব্রীজ নির্মাণের ফলে এখন আর বড় বড় নৌকাগুলো তো দূরের কথা, ছোট ছোট নৌকাও যাতায়াত করতে পারে না!
এখন সময় এসেছে। বর্তমান সরকারও নদী ও খাল দখল উচ্ছেদে বদ্ধ পরিকর। সারা দেশে এসব দখলদারদের উচ্ছেদসহ নদী ও খাল পুনঃখননে সরকার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে যাদের উদ্যোগ নেবার কথা তারা সচেষ্ট হলেই হয়তোবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খালটি হারানো যৌবন ফিরে পেতে পারে।
এ বছর এখনো পুরোপুরি বর্ষা আসেনি। সময় আছে আরো কয়েক মাস। ইতিমধ্যে সেই পুরনো চেহারা দেখা যাচ্ছে শহর খালের ওপর। একে তো বিউটি ফিকেশন প্রকল্পের পর শহর খালের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তার ওপর আবার ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। সর্বোপরি শহর খালের বাইপাস সড়কের পশ্চিমে এমনিতেই খালটির প্রশস্ততা কম, তার ওপর ওই দিকটিতেই খালের ব্যাসার্ধ কমিয়ে কে বা কারা একটি সড়ক পথ তৈরির ফলে খালের অস্তিত্ব পড়েছে হুমকির মুখে। গেলবার কচুরিপানা পরিষ্কার করে খালটিকে বাঁচিয়ে রাখা গেলেও এবার বোধ হয় তাও সম্ভব হবে না। বাইপাস সড়ক ব্রীজের পূর্ব ও পশ্চিমে খালের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, ভরা বর্ষায় প্রসব ব্যথা ওঠলে স্বাভাবিক ডেলিভারিতে খালের আপত্তি না থাকলেও সিজার ছাড়া গত্যান্তর থাকবে না।
লিটন চৌধুরী : সাংবাদিক ও ইতিহাস লেখক
litonc820@gmail.com
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মন্তব্য প্রতিবেদন
[sharethis-inline-buttons]