শুক্রবার বিকাল ৩:৪৫, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গৌরনগরের খুনোখুনি রক্তারক্তি থামান প্লিজ

সীমান্ত খোকন

বছর তিনেক আগে যখন এই গ্রামেই বিরাট একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তখন আমি বন্ধু-বান্ধবসহ গিয়েছিলাম সেই গ্রামে, নিউজ কভার করতে। গিয়ে যা অবস্থা দেখলাম তা কুরুক্ষেত্রকেও হার মানায়। জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল সেদিন। সে সময় এক ব্যক্তি নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিল। দেখেছিলাম, আমার চোখের সামনেই কীভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে দা দিয়ে কুপাচ্ছিল। মানুষের রক্তে ভিজেছিল ফসলি জমির মাটি।

উন্নত হওয়ার পথে থাকা একটি গ্রাম শুধুমাত্র গোষ্ঠীগত ঝগড়ার কারণে কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তার জলন্ত উদাহরণ হলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রাম। গত কয়েক বছর ধরে চলা সংঘর্ষের কারণে গ্রামটি আজ মৃতপ্রায়। সামান্য ভুল বুঝাবুঝি বা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে এ গ্রামের লোকেরা ধ্বংসাত্মক হানাহানিতে লিপ্ত হয়। আর এসব হানাহানি লাগিয়ে রাখে গ্রামের পাশের গ্রাম্য সর্দার-মাতব্বরেরা। গৌরনগরের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত হওয়ায় বেশিরভাগ সময়েই তারা সঠিক বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেন না। পাশের গ্রামের মাতব্বরদের উস্কানি তারা বুঝতে পারেন না। আর এ উপজেলার পুলিশ এসব ঝগড়া-বিবাদ সমাধানে তেমন ভূমিকা রাখে না। বরং এলাকায় জগড়া লগিয়ে রেখে ফায়দা লুটার অভিযোগ অনেকদিন আগে থেকেই চলে এসেছে।

এ ব্যাপারে সরাসরি অভিযোগ আছে নবীনগর থানার ওসি আসলাম সিকদারের বিরুদ্ধে। তিনি একপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে আরেক পক্ষের উপর জুলুম চালিয়েছেন। তাকে যে টাকা দিয়ে কিনে ফেলা হয়েছে তার অডিও রের্কড ভাইরাল হয়েছিল পাশের গ্রাম থানাকান্দিতে সংর্ঘের সময়। তবুও কি কারণে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা তার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি তা এক রহস্য। এ হলো নবীনগর পুলিশের ভুমিকা। এ ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে, যার কারণে নবীনগরের কিছু গ্রামে শান্তি আসে না কখনোই।

বছর তিনেক আগে যখন এই গ্রামেই বিরাট একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তখন আমি বন্ধু-বান্ধবসহ গিয়েছিলাম সেই গ্রামে, নিউজ কভার করতে। গিয়ে যা অবস্থা দেখলাম তা কুরুক্ষেত্রকেও হার মানায়। জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল সেদিন। সে সময় এক ব্যক্তি নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিল। দেখেছিলাম, আমার চোখের সামনেই কীভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে দা দিয়ে কুপাচ্ছিল। মানুষের রক্তে ভিজেছিল ফসলি জমির মাটি। দেখেছিলাম, কীভাবে একপক্ষ আরেক পক্ষের ঘরবাড়ি লুট করে নিয়ে যায়, কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল টিনের ঘর। হাতুরি-হেমার দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল দালান ঘর। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, চাল-ডাল কীভাবে লুট করা হয়েছিল তা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিন।

তাদের হাতে ভয়ানক অস্ত্র দেখে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার সাহস হলো না। নির্যাতিতরা নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে ফসলি জমির উপর দিয়ে দৌড়ে পাগলা নদী পার হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের গ্রাম শরিফ পুরে, যা আশুগঞ্জ উপজেলার অর্ন্তগত। আচমকা হামলা করায় দৌড়ে জীবন বাঁচাতে হয়েছিল তাদের। এ অবস্থা যে একদিন বা দু-চারদিন ধরে চলছে তা নয়। বছরের পর বছর ধরেই গ্রামটির এই অবস্থা। কিন্তু এর স্থায়ী সমাধানের জন্য কোনো মহলকেই ভালো চেষ্টা করতে দেখা যায় না। বরং এ বিষয়ে দুপক্ষই থানায় মামলা করে, আর থানাওয়ালারা এ সুযোগে দুপক্ষের কাছ থেকেই টাকা খায়। এছাড়াও পুলিশ তখন ধর-ছাড় বাণিজ্যে মেতে উঠে। তবে কি এই গ্রামের বোকা লোকগুলো নিজেরা ঝগড়ায় মেতে থাকলেই অনেকের লাভ? বিশেষ করে যারা এ বিষয়টি মিমাংসা করার কথা তাদের?

এসব বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখা যায়। অনেকে লিখছেনও দুহাতে। আমিও লিখতে পারি, কারণ গতবারের ঝগড়ার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত আছি দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু শুধু লিখলে আর নিউজ করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? দায়িত্বশীলরা যদি দায়িত্ব পালন না করে, দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না পায়, টাকার কাছে মাথানত করে, তবে সাংবাদিক ও লেখকের কলম পরিস্থিতির কতটা উন্নতি করতে পারবে?

যদিও একটি গণতান্ত্রিক দেশের মালিক জনগণ। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা হচ্ছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচরি বা জনগণের সেবক। কিন্তু আমাদের দেশে এ কথা কে বলবেন বা কে মানেন? সরকারি কর্মীগুলো জনগণের সাথে এমন ভাব ধরে বসে থাকেন, যেন তারা আমাদের সেবক নন, তারা আমাদের প্রভু।

যা হোক, এ অস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রাশাসক, পুলিশ সুপারসহ সকল মহলের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা গৌরনগরকে শান্ত করতে আপাতত একটি মূ্ল্যবান উদ্যোগ নিন। তারপর গ্রামের বাসিন্দাদের উপর দয়া করে কীভাবে স্থায়ী একটি সমাধান দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করুন। নবীনগরের একজন এমপি আছেন, যিনি তার এলাকার কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষে মুখে কুলুপ আঁটেন, আর হাতে পায়ে নিজেই শেকল পরেন…। তার নির্বাচনী এলাকায় বছরের পর বছর এমন চলতে থাকবে, এতে তিনি কোনো উদ্যোগ নেবেন না বা ভূমিকা রাখবেন না তা কেমন করে হয়?

সীমান্ত খোকন : সাংবাদিক ও লেখক

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply