“জীবন মানেই সমস্যা। সমস্যা ছাড়া কোনো জীবনই পূর্ণ নয়। তাই যে জীবনশিল্পী যত সুন্দরভাবে তার সমস্যাগুলো উত্তরণের পথ খুঁজে এর স্বার্থক মোকাবেলা করতে পারেন, তিনি তত বেশি সফল এবং তিনিই প্রকৃত জীবনশিল্পী। তিনি জীবনের চরম সত্যগুলো মেনে নিয়ে খুব সহজে জীবন পরিচালনা করতে পারেন। জীবনের গতিপ্রকৃতিকে পূর্ণ উপলব্ধির দ্বারা বৃহৎ কল্যাণে স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন।”
আধুনিক ‘শিক্ষিত’ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের মতামত ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে শিখেছে। কার কী প্রয়োজন, কী চাওয়া, কে কী ভাবল, সেগুলো আসলেই কতটা ঠিক-বেঠিক তা ভাবার সময় তাদের নেই। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলোকে অস্বীকারও করে। এমনকি চিরন্তন সত্যও তারা অস্বীকার করে। বর্তমান বস্তুবাদী এ সমাজের মানুষগুলো বস্তুগত সুখ-শান্তির দিকে অবিরাম ছুটে চলছে। বস্তুকে আকড়ে ধরতে গিয়ে আপন সত্তাকে অনুসন্ধান করার সময় ও চেষ্টা তাদের একেবারে নেই। নিজের দিকে ফিরে তাকাবেই-বা কী করে? নিজের মধ্যে যে আছে এক হিংস্র পশু! অন্যরা তার এ হিংস্ররূপ নিয়ে যতটা ভয় পায়, সে নিজেই তার এ রূপ দেখতে পেলে আরো বেশি ভয় পাবে। তাই সে নিজের দিকে ফিরে তাকায় না।
মানুষ মাত্রই দুটি বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক চাহিদার তৈরি। একটি ভাল, অপরটি মন্দ। কারো সত্তায় জাগতিক চাওয়া-পাওয়া প্রাধান্য পেলে সে সত্যিকার সুখের সন্ধান পায় না। আবার সেখান থেকে ফিরেও আসতে পারে না। অথচ তখন প্রকৃত ও কল্যাণকর সত্তাকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে ‘নিজেকে’ অনুসন্ধান করাটা অপরিহার্য। কেউ যখন নিজের মন্দ রূপটাকে সামান্যও উপলব্ধি করতে পারে, তখন সে সেখান থেকে কীভাবে বের হবে জানে না। বের হবার পথ আবিষ্কারে সে বারবার ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়। কারণ সে তো কখনো নিজের জীবনের গতি-প্রকৃতি ও ধরন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি। তবে যারা এসব নিয়ে ভাবে, তারা কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পারে। যেখানে মানুষ দুটি বিপরীতমুখী চাহিদা সমন্বয় করে জীবনযাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বিয়ের মাধ্যমে আবদ্ধ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তার ভিন্ন ভিন্ন সাংঘর্ষিক চাহিদা ও অবস্থার দিকে কীভাবে সমন্বয় করবে?
“বস্তুকে আকড়ে ধরতে গিয়ে আপন সত্তাকে অনুসন্ধান করার সময় ও চেষ্টা তাদের একেবারে নেই। নিজের দিকে ফিরে তাকাবেই-বা কী করে? নিজের মধ্যে যে আছে এক হিংস্র পশু! অন্যরা তার এ হিংস্ররূপ নিয়ে যতটা ভয় পায়, সে নিজেই তার এ রূপ দেখতে পেলে আরো বেশি ভয় পাবে। তাই সে নিজের দিকে ফিরে তাকায় না।”
আজকের প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নিজেদের মনে অবিরাম একের পর এক রঙিন স্বপ্ন দেখে। যার অধিকাংশ উৎপত্তি আবেগ থেকে, বাস্তবতার ধারে-কাছেও নেই। আবেগ আর বাস্তবতা পাশাপাশি রাখাকে তারা জরুরি মনে করে না। কিছু অতি আবেগী, আবার কিছু অতি-বাস্তববাদী। আবার একই মানুষ কখনো অতি আবেগী, কখনো অতি-বাস্তববাদী। এর একটিও সঠিক নয়। আবেগ ছাড়া বাস্তব চলতে পারে না, আবার বাস্তবতা ছাড়া আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দুটোর স্বার্থক সমন্বয় প্রয়োজন। চরম সমস্যাপূর্ণ এ সমাজে এককভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। তাছাড়া দুর্বল ও সবলের সমন্বয়ই সৃষ্টিগত সত্যের শিক্ষা।
আরো পড়ুন> প্রযুক্তি নির্ভরতার যাতাকলে অসহায় মানুষ
আজকের চরম সমস্যাগ্রস্ত ও ভারসাম্যহীন এ সমাজের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই একটা ব্যাপার ভুল করে থাকে। মানুষকে বিবেচনা করতে গিয়ে তারা অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তিকে প্রাধান্য দেয়। অথচ এসব ক্ষণভঙ্গুর। জীবনের মূল সমস্যাগুলো স্বার্থকভাবে মোকেবেলা করার যোগ্যতা তার মধ্যে কতটুকু আছে, কস্মিনকালেও তা বিবেচনা করে না। আজকের সমাজের অধিকাংশ মানুষই জীবন-সংঘাতের কঠিন সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার সঠিক পথ না পেয়ে সমস্যা-জর্জরিত বিষয়গুলো খুব সহজেই এড়িয়ে যায়। এটাকেই মনে করে চূড়ান্ত সমাধান। তাই বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমস্যার উদ্ভব হলে তারা একে অপরকে তালাক দিয়ে পরস্পর আলাদা হয়ে যায়।
এটা সম্পূর্ণই ভুল। অনেকে এক্ষেত্রে ইসলামের দোহাইও দেয়। অথচ ইসলামে এটা হচ্ছে ‘অনুমোদিত’ সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ। আবার অনেকে মোহাম্মদ সা.এর পালকপুত্রের ঘটনাও টেনে আনেন। অথচ সেটা ছিল পরবর্তী কোটি কোটি উম্মতের জন্য এক বিশেষ শিক্ষা। এ শিক্ষাকে শিক্ষার চোখে না দেখে তারা নিজের প্রবৃত্তিজাত স্বার্থ এবং নফসের পুজায় ব্যবহার করেন, যা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ।
“আজকের বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানী ও কথিত ধর্মীয় ব্যক্তিরা নিজেরাই পারিবারিক সামাজিক হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। অথচ নিজের সমস্যা সমাধানের পথ চিন্তা না করে শুধু অন্যের সমস্যা নিয়ে ভেবে কিছু সস্তা উপদেশ ও নীতিবাক্য দিয়ে নিজেদের সৎ চিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাহির করেন।”
জীবন মানেই সমস্যা। সমস্যা ছাড়া কোনো জীবনই পূর্ণ নয়। তাই যে জীবনশিল্পী যত সুন্দরভাবে তার সমস্যাগুলো উত্তরণের পথ খুঁজে এর স্বার্থক মোকাবেলা করতে পারেন, তিনি তত বেশি সফল এবং তিনিই প্রকৃত জীবনশিল্পী। তিনি জীবনের চরম সত্যগুলো মেনে নিয়ে খুব সহজে জীবন পরিচালনা করতে পারেন। জীবনের গতিপ্রকৃতিকে পূর্ণ উপলব্ধির দ্বারা বৃহৎ কল্যাণে স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন।
লেখকের সব কলাম
আজকের বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানী ও কথিত ধর্মীয় ব্যক্তিরা নিজেরাই পারিবারিক সামাজিক হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। অথচ নিজের সমস্যা সমাধানের পথ চিন্তা না করে শুধু অন্যের সমস্যা নিয়ে ভেবে কিছু সস্তা উপদেশ ও নীতিবাক্য দিয়ে নিজেদের সৎ চিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাহির করেন। বিয়ের বন্ধন স্থায়ীকরণ ও তালাক প্রতিরোধে তারা নিজেদের জীবনে ব্যর্থ। অথচ প্রকৃত চিন্তাভাবনা দ্বারা মানুষ যে সমাধান পায় তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় নিজের জীবনেই। তাহলে বুঝে নিতে হয়, আজকের ধর্মীয় ব্যক্তি ও ‘চিন্তাবিদগণ’ শুধু নিজরে পেটের আহার জোগাড় করার লক্ষ্যেই চিন্তা করছেন। যে কারণে পেট ভরলেও ব্যক্তিগত মানসিক ও পারিবারিক সমস্যার সমাধান আসছে না।
চলবে
শরীফ উদ্দীন রনি : শিক্ষক ও সাংবাদিক
ক্যাটাগরি: নারী, প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]