পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা ও বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা যায় না। ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবানু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক তাপমাত্রায় ৩০/৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানোর বিষয়টি সবার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই পানি ফোটালেও ঝুঁকি রয়েই যায়।
জীবনে পানির প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পানি পৃথিবীবাসির এক অমূল্য সম্পদ। কৃষি, শিল্প-কারখানা, উৎপাদনসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। বলতে গেলে পানি ছাড়া জীবন অচল। কৃষিপ্রধান বাংলদেশের খাদ্য নিরাপওা অর্জনে পর্যাপ্ত ব্যবহারযোগ্য পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের বিকল্প নেই। শস্য উৎপাদন বহুলাংশে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে।
আমরা জানি, পৃথিবীর ৭৫% এবং জীবদেহের ৬০ ভাগই হলো পানি। এমনকি উদ্ভিদেও তার দেহভরের বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে পানি। পানির আশ্চর্য দ্রবণীয় গুণাগুণ জীবনকে সম্ভাব্যতার মধ্যে ধরে রেখেছে। আশ্চর্য তরলীয় গুণাগুণ আছে বলেই জীবকোষ বা উদ্ভিদ কোষের সংকটকালীন জীবন বজায় রাখা সম্ভব। খাদ্য ও অপদ্রব্যের বহনের জন্য কেবল পানিই একমাত্র মাধ্যম। বর্তমানে পানি একটি র্দুমূল্য সম্পদ। এক কথায় বলতে গেলে, পানি ছাড়া জীবনধারণ সম্ভব নয়। বিশ্বে পানির দুষ্প্রাপ্যতা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে পানিদূষণ। শিল্প বিপ্লবের কারণে বায়ুদূষণের মতো পানিও দূষিত হচ্ছে। দূষণমুক্ত পানি সরবরাহ একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দূষণযুক্ত পানি। এই জাতীয় পানি প্রাণি ও উদ্ভিদ জগৎকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়।
এ সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান না হলে আগামী বিশ্বে হাহাকার পড়ে যাবে। তাই বলা হচ্ছে, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধে তবে তা হবে বিশুদ্ধ পানিসংকট নিয়ে। এ কারণে বিশ্বে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস চলছে। পানির যথাযথ ব্যবহার ও অপচয় রোধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশের অনেক জেলায় ভূগর্ভস্থ পানিতে উঠে আসছে আর্সেনিক নামক এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ, যা জীবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর ও ভয়াবহ। রাজধানীসহ মহানগরগুলোতে সরবরাহকৃত পানিতেও অনেক সময় ভারী ধাতু, সিসা ও মরিচার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। মহানগরগুলোতে মানুষের স্রোত বৃদ্ধি সাথে সাথে এ সমস্যাও বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা ও বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা যায় না। ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবানু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক তাপমাত্রায় ৩০/৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানোর বিষয়টি সবার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই পানি ফোটালেও ঝুঁকি রয়েই যায়। তাই সবাইকে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন- পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ পানির জন্য নির্ভর করা যেতে পারে প্রকৃতির উপরই। আর সেক্ষেত্রে প্রকৃতিকে নষ্ট করে ফেলা থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানির জীবানু থেকে টাইফয়েড, ডায়রিযা, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো জটিল রোগসহ মরণব্যাধি ক্যানসারেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা না পেলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করে বহুরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরগুলোতে কোটি কোটি লোকের বসবাস। এসব লোকের দৈনিক পানির চাহিদা রয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি লিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি করপোরেশন এ পানি সরবরাহ করছে। তবে রাজধানীবাসীর অভিযোগ, এ পানি মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লায় পারিপূর্ণ; দীর্ঘ সময় ধরে ফুটিয়েও পানি দুর্গন্ধমুক্ত করা যাচ্ছে না।
এক জরিপ থেকে জানা যায়, ওয়াসার সরবরাহরকৃত পানির ১৪ শতাংশ আসছে সায়েদাবাদ পানি শোধানাগার থেকে। বাকি পানি ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে এনে শোধন করা হচ্ছে। তবে নদী দুটির দূষণ এতই বেড়েছে যে পানি শোধনের পরও পানযোগ্য হচ্ছে না। এদিকে ভূগর্ভ থেকে পানি তোলায় পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পেলে আগামীতে পানি আরও বেশি দূষিত হবে। এ ছাড়া পানি বেশিমাত্রায় নিচে নেমে গেলে চাহিদা মেটানোও সম্ভব হবে না। পরিবেশ সংগঠন ‘পাবার’ এক জরিপে জানা যায়, দূষণের কারণে চারটি নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জরিপে আরও জানা যায়- শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, বালু ও তুরাগ নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় পানির প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর দশ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহি হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০/৩০ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগর গুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বচ্ছ পানিতেও ক্ষতিকর জীবানু থাকতে পারে। অনেকে ফুটিয়ে পানি পান করেন। কিন্তু সঠিক উপায়ে ফোটানো না হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতিটা প্রায় সবারই জানা। বেশিরভাগ বাসা-বাড়িতে বা পারিবারিক পরিবেশে পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় সরাসরি ডোবা, পুকুর বা খালের পানির ক্ষেত্রে অন্তত ৩০ মিনিট ধরে ফুটানোর কথা বলা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ডোবা, পুকুর বা খালের পানি যদি অধিক দূষিত হয়ে পড়ে বা ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পানিতে পাওয়া যায়, তা হলে ফুটিয়েও জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব হবে না। পসিংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ১৮০ কেটি মানুষের খাওয়ার পানির উৎস বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে যা তাদের কলেরা ,আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগ ও পোলিওর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অনিরাপদ পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার কারণে প্রতিবছর আট লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
২০৩০ সালে বিশ্বে পানির বর্তমান চাহিদা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। এই বর্ধিত চাহিদার বেশির ভাগই হবে নগরবাসীর। এই বর্ধিত চাহিদা মেটাতে হবে বর্জ্যপানি সংগ্রহ ও এর পুনর্ব্যবহার এবং পানির অপচয় রোধ করার মাধ্যমে। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃ পানি ফেলে না দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে- যেমন কৃষি কাজে তার পুনর্ব্যবহার করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রযোজন, পানি একটি অত্যন্ত মুল্যবান এবং সীমিত সম্পদ। যার টেকসই ব্যবস্থপনা গ্রহণ একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য আশু প্রয়োজন। একই পানিকে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করার উপায় বের করা এখন সময়ের দাবি।
প্রতিবেদন : খায়রুল আকরাম খান
ক্যাটাগরি: শীর্ষ তিন, সারাদেশ
[sharethis-inline-buttons]