ইংরেজির আরেকটি সমস্যা হল, ওতে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকদের ভোগবাদ, বস্তুবাদ, সংশয়বাদ, নৈরাশ্যবাদই প্রতিফলিত। জীবন সম্পর্কে অনেক সত্য উপলব্ধি ও জ্ঞান ওতে অনুপস্থিত। তাই মানবজীবন ও জগতের সামগ্রিক দিক নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে বাংলায় তা প্রকাশ করতে পারলে আমাদের চিন্তা-চেতনা যেমন উন্নত হবে, তেমনি বাংলা ভাষাকেও বৈশ্বিক মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতা দান করবে নিশ্চিত।
আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষাপ্রাপ্ত কিংবা বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য-নির্ভর শিক্ষাপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ এবং তরুণ প্রজন্মের লেখক-কলামিস্ট ও সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণই শুধু নয়, এখন বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাপ্রাপ্ত খাটি বাঙালি প্রজন্মও কথায় কথায় ইংরেজি ঝারে। এর বহুবিধ কারণ বর্তমান, আশা করি সেসব উল্লেখের প্রয়োজন নেই। একমাত্র যে ভাষার জন্য পৃথিবীর বিশেষ একটি জাতিকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে, সে ভাষার দেশে কোনোভাবেই ভিনদেশি ভাষার স্রোত মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। অথচ বিষয়টি খুবই সোজা। সরকার শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় ইংরেজির জায়গায় বাংলার প্রচলন করলেই হয়ে যায়।
অবশ্য সরকার যদি এটা নাও করে, তবু নতুন প্রজন্মের হাতে একটা সুযোগ আছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিত একটা অংশ এটা নিয়ে আন্দোলনে নামতে পারে এবং নিজেরাও এখন থেকেই প্রতিটি লেখা ও বলায় পুরোপুরি বাংলাভাষী হয়ে উঠতে পারে।
একমাত্র যে ভাষার জন্য পৃথিবীর বিশেষ একটি জাতিকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে, সে ভাষার দেশে কোনোভাবেই ভিনদেশি ভাষার স্রোত মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। অথচ বিষয়টি খুবই সোজা। সরকার শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় ইংরেজির জায়গায় বাংলার প্রচলন করলেই হয়ে যায়।
আজকের শিক্ষিত প্রজন্ম বলায় তো অবশ্যই, লেখায় আরো বেশি ইংরেজি ব্যবহার করে। ইংরেজি শব্দ-বাক্য ও বিদেশি লেখক-গবেষক-সাহিত্যিকদের উদ্ধৃতি ছাড়া তাদের লেখা যেন ‘পূর্ণতা’ পায় না। ইংরেজি শব্দ-বাক্যের সহযোগিতা ছাড়া তারা কোনো সাধারণ বিষয়ও বোঝাতে পারেন না। শিক্ষার বাহাদুরি ও ভদ্রলোকগিরি দেখাতে এটা এখন শুধু ‘স্টাইল’ বা ‘ফ্যাশনই’ নয়, রীতিমতো বাঙালির অভ্যাসেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু কেন? বাংলা ভাষার সৌন্দর্য কোনো অংশে কম? বাংলা ভাষায় সমার্থক শব্দের অভাব? যদি অভাব হয়ও, তবে সে অভাব তো আমাদেরই পূরণ করার কথা। ইংরেজি-নির্ভরতার কারণে এখন সত্যি সত্যি বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা শব্দের অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। যুগ ও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন বাংলা শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে না।
লেখায় যেহেতু ভাবনা-চিন্তার সময় বেশি, সম্পাদনাও করা যায়, সেহেতু ভেবেচিন্তে বাংলায় প্রয়োজনীয় নতুন শব্দ আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। অপ্রচলিত বাংলা শব্দগুলোর প্রচলন করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, ইংরেজি ছাড়া বিভিন্ন বিষয় আপনার ছাত্র, শ্রোতা বা পাঠকদের বোঝাতে পারবেন না। কিন্তু আমরা মনে করি, আপনি বুঝে থাকলে তারাও বুঝবে। তাছাড়া সব ভাষাতেই অমন সীমাবদ্ধতা একটা সময় থাকে। সেটা কাটিয়ে উঠতে চাইলে সাময়িক অসুবিধা মেনে নিতে হয়। আর বিদেশি ভাষা যতই সমৃদ্ধ হোক; ভাষা ভাষাই, বাস্তবতা নয়। ভাষার একটা সীমাবদ্ধতা সব ভাষাতেই থাকে। তাই বলে নিজের বহুল প্রচলিত মাতৃভাষা ছেড়ে দিয়ে অন্য ভাষার দ্বারস্থ হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
লেখায় যেহেতু ভাবনা-চিন্তার সময় বেশি, সম্পাদনাও করা যায়, সেহেতু ভেবেচিন্তে বাংলায় প্রয়োজনীয় নতুন শব্দ আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। অপ্রচলিত বাংলা শব্দগুলোর প্রচলন করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, ইংরেজি ছাড়া বিভিন্ন বিষয় আপনার ছাত্র, শ্রোতা বা পাঠকদের বোঝাতে পারবেন না। কিন্তু আমরা মনে করি, আপনি বুঝে থাকলে তারাও বুঝবে।
ভাবপ্রকাশ, আদান-প্রদান ও বোঝাবুঝির মূল ব্যাপারটি মানসিক উপলব্ধিজাত, অনুভূতিজনিত, জ্ঞানগত, আকার-ইঙ্গিতধর্মী, রক্ত-হাওয়া-পরিবেশ সংশ্লিষ্ট। তাই যে কোনো বিষয় বুঝতে ও উপলব্ধি করতে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। তাছাড়া ইংরেজির আরেকটি সমস্যা হল, ওতে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকদের ভোগবাদ, বস্তুবাদ, সংশয়বাদ, নৈরাশ্যবাদই প্রতিফলিত। জীবন সম্পর্কে অনেক সত্য উপলব্ধি ও জ্ঞান ওতে অনুপস্থিত। তাই মানবজীবন ও জগতের সামগ্রিক দিক নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে বাংলায় তা প্রকাশ করতে পারলে আমাদের চিন্তা-চেতনা যেমন উন্নত হবে, তেমনি বাংলা ভাষাকেও বৈশ্বিক মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতা দান করবে নিশ্চিত।
অতএব দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পেতে সাময়িক অসুবিধা কোনো সমস্যা হতে পারে না। যদি ভাবেন, আপনি একা আর কী করবেন? সাথে কে-বা থাকবে? কারা থাকবেন কি থাকবেন না জানি না, তবে আশা করি আমাদের আপনি পাশে পাবেন। পরিবর্তন শুরু হোক আমাদের এই কয়েকজন থেকেই।
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, সম্পাদকীয়
[sharethis-inline-buttons]