শুক্রবার বিকাল ৪:২৩, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

বাংলাদেশের সমস্যা ও সমাধানসূত্র

আবু এন এম ওয়াহিদ

প্রতিটি সমস্যা একটা আরেকটার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আলাদা আলাদাভাবে ‘কোটা’ আন্দোলন, ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলন, ‘পরিবেশ’ আন্দোলন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ’ আন্দোলন, ‘এপিওভূক্তি’ আন্দোলন, ‘দুর্নীতি বিরোধী’ আন্দোলন- এসব করে কোনোটারই সুরাহা হবে না, হয় সবগুলোর সমাধান এক সাথে করতে হবে, নয়তো কোনোটা থেকেই মুক্তি মিলবে না। কারণ এক সমস্যা আরেক সমস্যাকে নিরন্তর জিইয়ে রাখে।

আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যিই দেশ ‘এগিয়ে’ যাচ্ছে, বহুমাত্রিক ধারায়। মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের আয়-উপার্জন। জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে, দেশি শ্রমিকরা কাজের খোঁজে লাখে লাখে বিদেশ যাচ্ছেন, তৈরি পোশাক-রপ্তানি বাড়ছে, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক বৈদেশিক মুদ্রার পাহাড় গড়ছে, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ বিশ্বের ‘রোল মডেল’ এবং দেশে ‘গণতান্ত্রিক ধারা’ অব্যাহত আছে। এখানে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুশিক্ষা প্রায় শতভাগে পৌঁছে গেছে, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশের অপমানের পাহাড় ঠেলে পরিশ্রমী মানুষ মাতৃভূমির কপালে উন্নয়নশীল দেশের তকমা লাগিয়েছেন, ওই দূরে দেখা যায়- ২০৪১ সালে নাকি বাংলাদেশ ‘উন্নত’ বিশ্বের কাতারে নাম লেখাবে। বাহ! জাতির জন্য এর চেয়ে সুখবর আর কী হতে পারে! ক্ষমতায় যাঁরা থকেন তাঁরা এভাবে এই ভাষায়ই কথা বলেন। তাঁরা আরো বলেন, ‘‘উন্নয়নের’ এই বর্ণীল ধারা বজায় রাখতে আমাদেরকে আবার ভোট দিন’।

পক্ষান্তরে যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁদের বয়ান অন্য রকম। তাঁরা বলেন, এতো এতো উন্নয়নের মাঝে সমাজে এতো অস্থিরতা কেন, মানুষের মনে শান্তি নেই কেন, চারদিকে বিশৃঙ্খলা কেন, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি কেন নীতিতে পরিণত হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিন্ঠানগুলো লুট হয়ে গেল কিভাবে। তাঁদের প্রশ্নের তালিকাও দীর্ঘ। তাঁরা আরো বলেন, দেশ শাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা, দক্ষতা, সততা, ইত্যাদি নেই কেন? বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে পুঞ্জিভূত অভাব-অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রশমনে সরকার গাফেল কেন। বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মারামারি, মাস্তানির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কেন। সকল স্তরে নির্বাচন ব্যবস্থা এভাবে ভেঙ্গে পড়ল কেন, বিরোধী দলের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার দিনে দিনে কেন সঙ্কুচিত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের দাবীদাওয়ার ন্যায্যতা মানার পরও তাদের ওপর হামলা-মামলা কেন, রিমান্ড কেন, জেল-জুলুম কেন। সমাজে অপরাধ এতো বাড়ছে কেন, ধর্ষণ, নারীনির্যাতন ও খুনোখুনিতে নৃশংসতার মাত্রা ক্রমে ক্রমে বাড়তির দিকে কেন, মানুষ কেন সুবিচার থেকে বঞ্চিত, শিক্ষার হার বাড়লেও মান কমছে কেন? ধনী-গরিবের বৈষম্য কেন এত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেশের আনাচে কানাচে প্রতি নিয়ত কেন মানবিক মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে’? তারা আরো বলে থাকেন, ‘আমাদের ভোট দিন, আমরা এই দুঃশাসন থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দেব’।

বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার চালচিত্র এ দুয়ের মাঝামাঝি। সুযোগ পেলে জনগণ নিরাশার মাঝে আপত মুক্তির আশায় হয়তো বা ভোট দেবে, বিরোধী জোটকে হয়তো বা ক্ষমতায়ও বসাবে। সাময়িক একটু স্বস্তি মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু মূল সমস্যার কোনো সার্বিক ও স্থায়ী সমাধান হবে না। তার কারণ বহুবিধ। প্রথমত, সমস্যাগুলো অনেক কঠিন, জটিল, বহুমাত্রিক ও বহুদিনে গড়ে ওঠা এবং এদের শেকড় শক্ত মাটির নিচে অনেক গভীরে প্রোথিত। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি সমস্যা একটা আরেকটার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আলাদা আলাদাভাবে ‘কোটা’ আন্দোলন, ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলন, ‘পরিবেশ’ আন্দোলন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ’ আন্দোলন, ‘এপিওভূক্তি’ আন্দোলন, ‘দুর্নীতি বিরোধী’ আন্দোলন- এসব করে কোনোটারই সুরাহা হবে না, হয় সবগুলোর সমাধান এক সাথে করতে হবে, নয়তো কোনোটা থেকেই মুক্তি মিলবে না। কারণ এক সমস্যা আরেক সমস্যাকে নিরন্তর জিইয়ে রাখে।

তামাম সমস্যার সার্বিক ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান চাইলে একটি জাতিকে প্রথমে ঠিক করতে হবে, তার জীবন-পথের দর্শনটি কী হবে। মানব জাতির জীবনে ‘জীবনদর্শন’ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনে রাখতে হবে, একটি দল বা গোষ্ঠীর মনমতো জীবনদর্শন নির্ণয় করলে হবে না। এ কাজে সকল নাগরিকের অংশ গ্রহণ চাই, এতে সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকা আবশ্যক। তা না হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। আর বিভক্ত জাতি কোনো দিন কোনো বড় লক্ষ্য হাসিল করতে পারে না। সত্তরের দশকে স্বাধীনতার পর আমরা এ কাজটি করতে পারিনি, যেটুকু করার চেষ্টা হয়েছে তাও হয়েছে ভুল তরিকাতে। জাতি-দর্শন ঠিক করে তাকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়ীত করা গেলে বাকি কাজটি অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। তারপর সেইমতো তৈরি করতে হবে একটি পরিপূর্ণ জাতীয় নীতিমালা ও নীতিকাঠামো, যার দ্বারা পরিচালিত হবে দেশের প্রতিটি সেক্টর ও সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

তারপর দেশব্যাপী একযোগে শুরু করতে হবে নীতিমালার বিস্তারিত বাস্তবায়ন। ষোল-সতেরো কোটি মানুষের দেশে জাতীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য দরকার হবে একটি বিশাল সৎ ও দক্ষ জনবল এবং এদেরকে ছোটবেলা থেকে গড়ে তুলতে হবে দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল ও মানবিক মানুষ হিসেবে। এ প্রক্রিয়াটি যেমন সহজ নয়, তেমনি স্বল্পমেয়াদে সম্ভবও নয়। তাই এর জন্য তিন ধাপে- স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বে অবশ্যই থাকবেন রাজনীতিবিদরা। কারণ তাঁরাই দেশ চালান, তাঁরাই দেশের নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরাই দেশের আইন বানান, কিন্তু অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এই বিশাল ও মহৎ কাজটি বর্তমান ধারার রাজনীতি ও বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের দিয়ে হবে না, কারণ এখন যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের বেশির ভাগই মতলববাজ। তাঁরা অসৎ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থপর, অদক্ষ এবং তাঁদের মাঝে দেশপ্রেমের ঘাটতিও বিশাল! রাজনীতিতে যে দু-চারজন সৎ লোক আছেন, তাঁরা দুর্বল, দল ও সরকারের ওপর তাঁদের প্রভাব – হয় নেই, নইলে অতি নগণ্য এবং তাঁদের বয়স, শক্তি ও কর্মদক্ষতারও অভাব রয়েছে।

মোট কথা, বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সার্বিক সমস্যাটি অনেক জটিল ও কঠিন একটি ক্রনিক রোগের মতন। তাই এর কোনো সহজ ও তড়িৎ সমাধান নেই। জাতি হিসেবে এই বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের এগুতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে পৃথক পৃথক আন্দোলন করে সমাজে সাময়িক হই চই ফেলা যাবে, কিন্তু কোনো সমস্যারই কোনো কূলকিনারা হবে না। আবারো বলছি, সব রসুনের যেমন একই গোড়া তেমনি বাংলাদেশের যাবতীয় অনাচার, অত্যাচার ও জুলুমের মূল একই জায়গায়। একে নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস, শক্তি, সততা, দেশপ্রেম, ধৈর্য, দৃঢ় প্রত্যয় ও কঠিন অঙ্গীকার। এর সব ক’টি গুণাগুণ আছে তারুণ্যের মাঝে এবং কেবলই তারুণ্যের মাঝে।

তবে রাজপথে নেমে তরুণরা এসব দীর্ঘমেয়াদি জটিল জাতীয় সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করে তাদেরেকে এগিয়ে এসে দেশের রাজনীতির হাল ধরতে হবে। পাল্টে দিতে হবে প্রচলিত ধারণা ও কাজকারবারের খোলনলচে। বাংলাদেশের তরুণরা যতদিন নব দীক্ষায় বলীয়ান হয়ে দলে দলে এসে রাজনীতিতে যোগ না দেবে ততোদিন একটা পর্যায় পর্যন্ত দেশের আয়-উন্নতি হবে ঠিকই, কিন্তু মৌলিক সমস্যাদীর কোনো স্থায়ী সমাধানের পথ তৈরি হবে না, সমাজে ইনসাফ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে না, এবং এটা আশা করাটাও নিরেট বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়।

আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক- টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
awahid2569@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply