রবিবার সকাল ১০:১৫, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাঙালির নানামুখী সংকট

নাঈম আহমেদ

আমরা মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। কমিউনিকেশনে 2G থেকে 5G এই প্রজন্ম পেয়ে গেছে। বিলাসিতার আচ্ছন্নে অনেকে মুঠোফোন ছেড়ে ল্যাপটপে ফেসবুকিং করছে। অথচ মফস্বলে থাকা হাজারো পরিবারের সীমিত আয়ের মধ্যে কেবল খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা এদেশের কোনো মেধাবির কাছে নেই কেন?

শিক্ষা যতটা না মেরুদণ্ড, তার চেয়ে জোর দিয়ে বলা দরকার মস্তিষ্ক। রক্তে মাংসে গড়া মস্তিষ্ক সবার আছে। ওজনটাও প্রায় সমান। স্কুলের বারান্দায় পা রাখা থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের উত্থান পতনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজগতটাকে একটা চরম দায়বদ্ধতার জায়গা বলে মনে হয় প্রায় সবার কাছেই। কমবেশি অভিযোগও অনেকেই তোলে, শিক্ষাজীবন ও ব্যবস্থার তাৎপর্য নিয়ে। অভিযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ সমগ্র বিষয়টাই পূর্বনির্ধারিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এটি কেবল পরিণত হচ্ছে নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের উঁচুস্তরের বিত্তশালী ক্ষমতাসীনদেন কর্মক্ষেত্রে সহযোগী হবার ট্রেনিং হিসেবে। তারা অর্থ এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখবে মানুষের মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় ও চাহিদার প্রলোভন দেখিয়ে। ঠিক এই জায়গাটাতে আমাদের মস্তিষ্ক দারুণ অসহায়। বেশ দুর্বল। বেঁচে থাকার জন্য নুন্যতম ও স্বাভাবিক চাহিদাগুলো পুরণে প্রতিনিয়ত নিজেদের মুখাপেক্ষী বানিয়ে তুলছি। প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা। সার্টিফিকেট আর নম্বরপত্রের ছকের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছি নিজের যোগ্যতা ও মেধাকে।

না করে উপায়ও নেই। সমাজে মূল্যায়নের মাপকাঠি অর্থ ও ক্ষমতাকে পুঁজি করতে হলে সহোযোগিতার চেয়ে প্রতিযোগিতাই সঠিক পদ্ধতি- এমনটাই অনুমান। অনেক পেছন থেকে সভ্যতার ইতিহাসটা বিচার করলে দেখা যায়, বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারটার সূচনাই হয়েছিলো ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবে। ঠিক সেই সময়টাতে যদি তখনকার সমাজটাকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে দেখা যায়, তখন উৎপাদনশীল অর্থনীতি ও বণ্টনের অনেকটাই সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। কৃষিভিত্তিক সমাজের অগ্রগতি তৎকালীন সমাজের মানুষদের দিয়েছিলো একটি স্বভাবিক ও সহজতরভাবে বেঁচে থাকার উপায়-ব্যবস্থা। তখনকার সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে। ছিলো না কোনো জীবনের মৌলিক চাহিদার দায়বদ্ধতা। জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলনের মৌলিক ভিত্তি ছিলো কৌতূহল ও প্রকৃতির বিষ্ময়। যুক্তি-তর্ক, নিরলস অন্বেষণে সবচেয়ে বেশি এমনকি রাতারাতি বিজ্ঞান ও দর্শনের অগ্রগতি ঘটেছিলো।

বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এটি কেবল পরিণত হচ্ছে নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের উঁচুস্তরের বিত্তশালী ক্ষমতাসীনদেন কর্মক্ষেত্রে সহযোগী হবার ট্রেনিং হিসেবে। তারা অর্থ এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখবে মানুষের মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় ও চাহিদার প্রলোভন দেখিয়ে। ঠিক এই জায়গাটাতে আমাদের মস্তিষ্ক দারুণ অসহায়। বেশ দুর্বল।

সময়ের পরিক্রমায় মানুষ অনুমান করতে শিখে, জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগগুলো সহজলভ্য করার জন্যে তাদের এই জ্ঞান ও যুক্তির সারাংশ অনেকটা সহায়ক। এই বিষয়টা অন্ন-বস্ত্রের চিন্তায় মগ্ন মানুষদেরও প্রভাবিত করেছে যুগের পর যুগ। কেউ প্রকৃতির ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে তার উপর ভিত্তি করে জীবনে সমৃদ্ধির চিন্তা করতো। কেউবা সৃষ্টির বিষ্ময়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতো। অন্ন-বস্ত্রের চিন্তা উপেক্ষা করেও জগতের বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতো। তাই দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানের প্রসার ও উৎপত্তির দুটো কারণকেই প্রাধান্য দেয়া হয়- বিষ্ময় ও প্রয়োজনীয়তা।

আজকের দিনে এসে বিষয়গুলোতে বেশ পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত চাইছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোকে এক বিলাসবহুল জীবনযাত্রার উপাদান করে তুলতে। যার ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উৎপাদনশীল অর্থনীতি। প্রজন্মের মাথায় চেপে বসেছে- বিজ্ঞানচর্চা মানেই ল্যাবরেটরি আর যন্ত্রপাতির সমারোহে আবদ্ধ কোনো জগৎ। রাষ্ট্র, সমাজের সচ্ছলতা সমৃদ্ধির মুল কেন্দ্রবিন্দু কৃষি খাতের উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন। অন্ন-বস্ত্রের, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো যখন মানুষের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখে, তখন তাদের দিয়ে প্রকৃতির বিষ্ময়ের রহস্য উন্মোচন, মহাশূন্যের ব্ল্যাক হোলের তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করানো কখনোই সম্ভব নয়। জীবন থেকে চাহিদাভাবনা দূর করতে না পারলে গবেষণায় উন্নতি হয় না।

আমরা মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। কমিউনিকেশনে 2G থেকে 5G এই প্রজন্ম পেয়ে গেছে। বিলাসিতার আচ্ছন্নে অনেকে মুঠোফোন ছেড়ে ল্যাপটপে ফেসবুকিং করছে। অথচ মফস্বলে থাকা হাজারো পরিবারের সীমিত আয়ের মধ্যে কেবল খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা এদেশের কোনো মেধাবির কাছে নেই কেন? দ্রব্যমূল্য অনিয়ন্ত্রিত, কৃষকের ধানের জমিতে আগুন, চিকিৎসার নামে স্বাস্থ্যব্যবসা, সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা মত ও শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্বাধীন গঠনমূলক মত প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা, উচ্চশিক্ষার নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অংকের অর্থের লেনদেন। এই মৌল সমস্যাগুলো সমাধান ব্যতীত মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট, 5G আরও কথিত উন্নয়ন আমার কাছে গৌণ বলেই বিবেচিত হয়।

স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে পরিস্থিতি ও জ্ঞানগত হতাশা বিরাজ করে, সেগুলো তাদের পরবর্তী জীবনে ক্ষোভ ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে না। আর এই হতাশাগুলো তৈরি হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে productive সময়ে, ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যেই। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখছে। আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুসরণে বেশ পারদর্শী। অনেক চিন্তাশীলরাও নিজেদের বাঙালি পরিচয়টা ঢেকে রেখে ইউরোপীয় টাইটেল দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

অন্যদিকে পরিবারই শৈশব-কৈশর থেকে ভিন্নধর্মী ভিন্নমতের বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কে। পরিবার ও সমাজ ভেতরে ভেতরে বেশ গভীরভাবে পার্থক্য করে ফেলছে শিক্ষা বা জ্ঞানের দুটো অর্থ থাকতে পারে, এক. ইহকালের আধুনিক শিক্ষা, দুই. পরকালের ধর্মীয় শিক্ষা। আবার এ দুটো পার্থক্যের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন দর্শনে ভরপুর। তাহলে প্রশ্ন, যে জাতি শৈশব-কৈশর থেকেই জগতচিন্তা ও জীবনবোধের উপর সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠে, তাদের জ্ঞানগত ঐক্যবদ্ধতার জায়গাটা কোথায়? এর নেতিবাচক প্রভাবটাও দেখা যাচ্ছে বর্তমান রাজনীতি ও সাম্প্রতিকতায়। স্কুল কলেজগুলো হয়ে উঠেছে পরীক্ষার নম্বরপত্র আর সার্টিফিকেটকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদেরকে চরমভাবে শোষণের হাতিয়ার। বিশেষ করে কলেজ লেভেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বেশ অসহায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অসহায় হয়ে পড়ে অর্থনীতির বাজার ও রাজনীতির কাছে।

স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে পরিস্থিতি ও জ্ঞানগত হতাশা বিরাজ করে, সেগুলো তাদের পরবর্তী জীবনে ক্ষোভ ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে না। আর এই হতাশাগুলো তৈরি হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে productive সময়ে, ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যেই। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখছে। আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুসরণে বেশ পারদর্শী। অনেক চিন্তাশীলরাও নিজেদের বাঙালি পরিচয়টা ঢেকে রেখে ইউরোপীয় টাইটেল দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার দিক থেকে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কিন্ডারগার্টেনই বলা যায়। তারা এই ব্যাপারে দারুণ উদাসীন। পরিসংখ্যান তো বলছে, আমাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে। গোল্ডেন A+ধারী শিক্ষার্থী অনেকগুণ বেড়েছে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেড়েছে। দেশে এখন আর গরিব নেই। আসলেই গরিব নেই। গরিব শেষ। গরিবের জ্ঞানচর্চা আর গবেষণার দৌড় চাহিদার দায়বদ্ধতায় বারে বারে বেঁধে ফেলতে চায় সমাজ।

নাঈম আহমেদ : শিক্ষার্থী

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply