“একটি উন্নত রাষ্ট্রের মানুষগুলো হওয়ার কথা সুখী। তা না হয়ে প্রতি বছর ১৭ মিলিয়নের মত মানুষকে শুধুমাত্র বিষণ্নতার মত একটি তুচ্ছ রোগে ভোগে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মিডিয়াগুলো প্রতিনিয়ত সেসব মানুষের অনিশ্চয়তা, অশান্তি ও হতাশার খবরে ভরপুর থাকে। সুতরাং তাদের এই নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কি আমরা তাদের উন্নত বলতে পারি?”
প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আত্মশক্তির অবমূল্যায়ন করে আজ যান্ত্রিকশক্তির বিকাশই যেন মানবজীবনের ধারক। যান্ত্রিক সমাজে একটি যন্ত্রের যতটুকু মূল্য রয়েছে একজন মানুষের ততটুকু মূল্য নেই। মানুষ দিন কি দিন রাত কি রাত পরিশ্রম করে একটি যন্ত্রকে উন্নত পর্যায় থেকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে মানুষকেই আজ অবহেলিত ও নিষ্প্রয়োজনীয় ভেবে যন্ত্রকে শ্রেষ্ঠত্বের ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। একটি দেশের উন্নত যন্ত্র থাকার উপর নির্ভর করছে তার শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব। যে মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্রকে উন্নত করা হচ্ছে তার কোনো অবস্থানগত মূল্যও নেই। যন্ত্রের অপব্যবহারের কারণে সভ্যসমাজের মানুষগুলো আজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। তাই যন্ত্রের অপব্যবহার রোধ বিশেষ জরুরি। তা না হলে এই যান্ত্রিক সভ্যতা অচিরেই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
একবিংশ শতাব্দীর মানুষগুলোকে যদি প্রশ্ন করা হয়, একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি কী? তারা একবাক্যে উত্তর দিবে, যে রাষ্ট্রে যত বেশি উন্নত প্রযুক্তি বা যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের (যা মানুষের মনে ভীতি জাগাতে পারে) মজুদ যত বেশি, সে রাষ্ট্র তত উন্নত ও শক্তিশালী । প্রকৃতপক্ষে প্রযুক্তি বা উন্নত যন্ত্রই যদি দেশ বা জাতির উন্নয়নের মাপকাঠি হতো তবে বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত এগুলোই হতো সবচেয়ে উন্নত রাষ্ট্র। যে দেশের নাগরিকদের জীবনের নিশ্চয়তা নেই, সে কী কখনো উন্নত রাষ্ট্রের প্রতীক হতে পারে? একটি উন্নত রাষ্ট্রের মানুষগুলো হওয়ার কথা সুখী। তা না হয়ে প্রতি বছর ১৭ মিলিয়নের মত মানুষকে শুধুমাত্র বিষণ্নতার মত একটি তুচ্ছ রোগে ভোগে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মিডিয়াগুলো প্রতিনিয়ত সেসব মানুষের অনিশ্চয়তা, অশান্তি ও হতাশার খবরে ভরপুর থাকে। সুতরাং তাদের এই নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কি আমরা তাদের উন্নত বলতে পারি?
রাষ্ট্রের উন্নয়নের মাপকাঠি হল তার সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞাননীতি। এ সব নীতি যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা জাতি কল্যাণ লাভ করলে তাকে সুনীতি বলে আখ্যায়িত করা যাবে। প্রয়োগের দ্বারা অকল্যাণ হলে তা সাথে সাথে পরিবর্তন করে কল্যাণকর নীতি প্রনয়ণ করা আবশ্যক। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে সঠিক বিজ্ঞাননীতির বড়ই অভাব। বিজ্ঞানের অপব্যবহার দ্বারা আজ বিশ্ব ক্ষতির সম্মুখীন।বাস্তবের দিকে তাকালে এর চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। কাগজে কলমে একরকম বিজ্ঞাননীতি থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ব্যবহারকারীরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই ব্যবহার করছে। অপব্যবহারকারীরা অপরাধ করেও শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে না। প্রযুক্তি উদ্ভাবন কর্মী ও প্রতিষ্ঠনাগুলোরও একই অবস্থা। যে হারে প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে তাতে সঠিক বিজ্ঞাননীতির কঠোর ও বাস্তবসম্মত প্রয়োগ না হলে সত্য ও কল্যাণকর বিজ্ঞান ধ্বংস হয়ে যাবে।
“রাষ্ট্রের উন্নয়নের মাপকাঠি হল তার সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞাননীতি। এ সব নীতি যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা জাতি কল্যাণ লাভ করলে তাকে সুনীতি বলে আখ্যায়িত করা যাবে। প্রয়োগের দ্বারা অকল্যাণ হলে তা সাথে সাথে পরিবর্তন করে কল্যাণকর নীতি প্রনয়ণ করা আবশ্যক। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে সঠিক বিজ্ঞাননীতির বড়ই অভাব।”
আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে অগ্রগামী করা নয়। বরং ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাস ও ক্ষমতা দখল বা হস্তান্তরই উদ্দেশ্য। তাই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার আমাদের সামনে খুব অল্পই দৃশ্যমান হয়। যে সব নিত্য-নতুন প্রযুক্তি আমাদের সামনে আসছে তাদের সৎ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে মানুষ হিংস্রতর আপডেটেড হওয়া থেকে রক্ষা পেত। তাই কোনো প্রযুক্তি বাজারজাত করার পূর্বেই তার সুব্যবহার নিশ্চিতকরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সব প্রযুক্তি যেন সবার হাতে না পৌঁছে সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। বয়স ও কাজের পার্থক্য অনুযায়ী প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নির্বাচন ও ব্যবহার করা আবশ্যক। যার যার কাজের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। আধুনিককালে প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রযুক্তির ব্যবহার অপেক্ষা অপব্যবহারই বেশি। এতে একদিকে যেমন অর্থ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে মেধারও অপচয় হচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে জাতিসমূহ আজ অসংখ্য তরুণ মেধা ও মেধাবী হারাতে বসেছে। অথচ এসকল তরুণকে প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহারে প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারাই একদিন গোটা পৃথিবীর সম্পদে পরিণত হত। সমগ্র পৃথিবী উপহার পেত একদল তরুণ ও নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ।
এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে প্রযুক্তির সুষম বণ্টণ নিশ্চিত করা যায়? যে উদ্যোক্তারা প্রযুক্তির বাজার দখল করে আছে তাদের জন্য এ কাজ খুব কঠিন নয়। কারণ তাদের প্রযুক্তি নির্মাণ কৌশল বের করতে হবে, নিয়ম-নীতিও প্রণয়ন করত হবে। তাই এক্ষেত্রে যারা পুরনো তারা খুব সহজে শুধুমাত্র দুয়েকটা নীতিতে চলে আসলেই কাজটা সহজ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের উচিত, প্রতিটি দেশে পৃথক পৃথক প্রযুক্তির ব্যবহারোপযোগী সঠিক লোকসংখ্যা কত তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী প্রযুক্তি বাজারজাত করা। তাহলে অতিরিক্ত কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। একটি আন্তর্জাতিক আইনও প্রণয়ন করতে হবে যে কেউ ইচ্ছা করলেই প্রয়োজন ব্যতীত নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে না। ব্যবহার করলে তাকে যথাযোগ্য শাস্তি পেতে হবে। এ ধরনের নিয়ম-নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হলে একদিন পৃথিবীটা মেধার অভাবে বিজ্ঞান নামক বিশেষ জ্ঞানের কথা ভুলে যাবে। প্রতিটি নাগরিককে অবশ্যই অনুধাবন করাতে হবে, শুধুমাত্র প্রযুক্তিই নয়, যে কোনো কিছুই ব্যবহার না করে অপব্যবহার করলে দুর্ভোগ এবং ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
“কোনো প্রযুক্তি বাজারজাত করার পূর্বেই তার সুব্যবহার নিশ্চিতকরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সব প্রযুক্তি যেন সবার হাতে না পৌঁছে সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। বয়স ও কাজের পার্থক্য অনুযায়ী প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নির্বাচন ও ব্যবহার করা আবশ্যক। যার যার কাজের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি।”
প্রতিনিয়ত টেলিভিশন বা খবরের কাগজ খুললে হানাহানি মারামারি ব্যতীত আর কোনো তথ্য পাওয়া মুশকিল। যদিও আমরা নিজেদেরকে আধুনিক ও সভ্য বলে দাবি করি। সভ্যতার সংজ্ঞা কি তবে কালের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে গেছে? না হয় এত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ একটি পৃথিবীকে আমরা কী করে বলি সুন্দর ও শান্তিময়? আবার নিজেদের ক্ষতি করেই ক্ষান্ত নয়, অপরের ক্ষতি করার লক্ষ্যে নিজেদের মতামত ও কথিত সংস্কৃতি ঢালাওভাবে প্রচার করছি। পৃথিবীর মানুষগুলো আজ এই গণ্ডীর বাইরে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব দেখছে। এর বিপরীতে তথ্যসমৃদ্ধ কোনো কল্যাণকামী সংস্কৃতি ও মত প্রতিষ্ঠিত হলে তা বিতারিত হবে। শিক্ষামাধ্যমগুলো আজ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর।
প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার সুফল যেমন রয়েছে তেমনি কুফলও রয়েছে। বর্তমানে মানুষকে কোনো তথ্যের জন্য খুববেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না, অল্প সময়ের মধ্যেই সে তার কাক্সিক্ষত তথ্য পেয়ে যায়। এর সাথে জড়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধু নামকাওয়াস্তে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বইটি ব্যাগে সাজিয়ে রাখার বস্তুতে পরিণত করেছে। এর দ্বারা যদি ছাত্রছাত্রীদের ন্যুনতমও সচেতন করা যেত তবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো। শুধুমাত্র ল্যাপটপ আর প্রজেক্টর দ্বারা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে গিয়ে সংগৃহীত কিছু তথ্য আলাপ-আলোচনা করেই শিক্ষার্থীদের উন্নত করা যায় না। প্রয়োজন সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করে তাদেরকে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার শেখানো, রোবট আর যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ বা উন্নত করা শিখেই পৃথিবীতে শক্তিশালী হওয়া নয়।
লেখকের সব কলাম
বিজ্ঞানের চারিদিকে আজ বিজয়োল্লাস! মানবতার কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্য শুধু পারমাণবিক বোমা ও মহাকাশ জয়(?)। আজ বিশ্বের এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যে কিনা পারমাণবিক বোমা ও মহাকাশজয়ের জন্য মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে না। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে খাবারের অভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু-কান্না। এই করুণ চিত্র আমরা লক্ষ্য করি না। নিজেদের ‘জীবনভাবনা’ নিয়েই ব্যস্ত আছি। অথচ এই পৃথিবীও আমার আপনার কাছ থেকে কিছু প্রাপ্য। প্রাপ্যটা আদায় করা একান্ত জরুরি। মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পৃথিবীতে যাবতীয় কিছুর মূলে রয়েছে মানুষ।
প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার মানবকুলের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। যেসব প্রযুক্তি মানবকুলের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব নিষিদ্ধ করাই শ্রেয়। আজ আমরা ঠিকই উপলব্ধি করছি যে কোন প্রযুক্তিগুলো আমাদের প্রয়োজন আর কোনগুলো নিষ্প্রয়োজনীয়। একটি স্কুলপড়ুয়া ছেলের প্রয়োজন নেই লক্ষ টাকা দামের মোবাইল। সে তা ব্যবহার না করে কেবলমাত্র নিজের হস্তসৌন্দর্য বর্ধন ও অপব্যবহারই করে থাকে। এতে করে তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিবিধি বিপর্যস্তের দিকে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। তাই প্রযুক্তি নির্মাণের পূর্বে স্বার্থ ও অনুমাননির্ভর না হয়ে তার সঠিক নীতিমালা ও বণ্টণবিধি নির্ধারণ করা আবশ্যক।
শরীফ উদ্দীন রনি : বার্তা সম্পাদক, দেশ দর্শন
ক্যাটাগরি: ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান, প্রধান কলাম, শিক্ষা-গণমাধ্যম
[sharethis-inline-buttons]