বৃহস্পতিবার বিকাল ৪:২২, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকার

কোহিনূর আক্তার প্রিয়া

প্রচলিত শিক্ষা মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান করে তোলে না, যা দেশে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, খুনের তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণিত।

নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নারীকে পদে পদে হেয় বা অবমাননা করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা, নারীর অর্জন বেহাত করা, জোর খাটানো, গৃহস্থালিতে সম্পৃক্ত নারীর কাজের অবমূল্যায়ন, অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়া, যৌন ও অন্যান্য নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নারী তথা মানব সভ্যতায় সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়ংকর রূপ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে ধর্ষণ।

ধর্ষণ শিশু ও পুরুষের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। ব্যক্তির ইচ্ছা বা সম্মতির বাইরে জোরপূর্বক যৌন হেনস্তা বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ বলা হয়। এটি কখনো একক পুরুষ কর্তৃক বা দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে ৭ জন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ৭ শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উন্নত-অনুন্নত সব দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র অমানবিক।

বাংলাদেশের বিগত পাঁচ বছরের ধর্ষণচিত্র বিশ্লেষণ করে খুব বেশি ভালো ফল দেখা যায়নি। সরকারের নানা চেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক পদচারণার পরও দেশের ধর্ষণচিত্র ঊর্ধ্বগামী। তবে এখানে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন, অধিকাংশ দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান জানার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের অভাব রয়েছে। আমাদের মূল তথ্যসূত্র হচ্ছে থানায় রিপোর্টকৃত সংখ্যা ও দৈনিক খবরের কাগজ।

একটি দৈনিক পত্রিকার হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছরে ধর্ষণের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ১৫৪ জন। যে কোনো বিচারেই এ চিত্র যদিও খণ্ডচিত্র, কিন্তু আশঙ্কাজনক। একটি দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বিরাট অন্তরায়। সে কারণেই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যেতে আগ্রহী সরকার। সম্প্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাশ হয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, অবহেলা ও নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়মিত, কার্যকরী এবং শক্তিশালী নিরীক্ষণের আওতায় আনা জরুরি।

কেন বাড়ছে ধর্ষণ: ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি তথা ঘৃণ্যতম অপরাধের পেছনে দায়ী বহুমুখী কারণ। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজ বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- সামাজিক অস্থিরতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, যৌন ও প্রজনন শিক্ষার অভাব, নৈতিক মূল্যবোধজনিত শিক্ষার অভাব, বিচারহীনতা ও অবিচারের সংস্কৃতি, সিস্টেম ক্রাইসিস, হিংস্র বয়ান, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি।

ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয়: একটি উন্নত ও মানবাধিকারসম্পন্ন নিরাপদ দেশ গঠনের জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা অত্যন্ত জরুরি। এ কথাও সত্য যে, সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও অন্য যে কোনো অন্যায় বা অপরাধের মতো আমরা হয়তো ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ বা বন্ধ করতে পারব না; তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক ও আইনি প্রতিকার এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে।

নারীর রূপকার বা চালিকাশক্তির ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও সম্মান করা: প্রতিটি নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি বা নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং তার অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, স্বকীয় জীবন বিকাশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে, অন্যায় প্রতিরোধে নারীকে এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যেন তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শেখে যে ‘না’ বলার ও ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার ও সক্ষমতা তার রয়েছে।

পারঙ্গমতার (জ্ঞান+দক্ষতা+মানসিকতা) উৎকর্ষ সাধন : আমাদের প্রচলিত শিক্ষা মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান করে তোলে না, যা দেশে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, খুনের তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণিত। সে কথা মনে রেখে মাঠ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিটি দায়িত্বশীল পদে আসিন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সমস্যা উত্তরণে কৌশলগত যোগ্যতায় যোগ্যতর করে গড়ে তুলতে হবে, যোগ্যতার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ও প্রতিজনের কর্মদক্ষতা নিয়মিত নিরীক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, অবহেলা ও নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়মিত, কার্যকরী এবং শক্তিশালী নিরীক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এ দায়িত্বে পরিবার, পাড়া-পড়শি, সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশব্যাপী মানবতা উন্নয়নের এ ধস বন্ধ করতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে সুরক্ষার সর্বজনীন আন্দোলন সৃষ্টি, যা এগিয়ে নেওয়ার এখনই সময়।

কোহিনূর আক্তার প্রিয়া: সাংবাদিক ও নারী সংগঠক 

ক্যাটাগরি: মিনি কলাম

ট্যাগ: কোহিনূর আক্তার প্রিয়া

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply