সমাজে নিজেদের অবস্হানকে উপহাসের করে তোলার ভয়ে আমরা সবাই গ্রাম, গ্রামের আত্মীয়দের ভুলে, ফটাফট ইংরেজি বলা মডার্ন বা আধুনিক পরিবার হয়ে গেছি। তাও রাতারাতি। অর্থ্যাৎ আমাদের কোনো গ্রাম নেই, গ্রামের আত্মীয়ও নেই।
অনেক বছর আগের কথা, আমি তখন চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারী হাইস্কুলের ছাত্রী। আমার দাদী আমাদের সাথে থাকতেন। আব্বু ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডে। বাসাটা ছিল চাঁদপুর ষোলঘর ওয়াপদা কলোনীতে। হঠাৎ এক ভর দুপুরে আব্বুর গ্রামের বাড়ি থেকে দুজন আত্মীয় আসলেন। একজন মধ্যবয়স উত্তীর্ণ নারী আর সাথে তার কলেজ ছাত্র ছেলে। আমাদের ছোট বেলায় গ্রামের বাড়ি , গ্রামের আত্মীয়দের খুব গুরুত্ব ছিল। আমরা নিয়মিত নানা আত্মীয়দের বাড়িতে নানা নিমন্ত্রনে যেতাম। এর ভিতর বেশি ছিল বিয়ে , সুন্নতে খাতনা , চল্লিশা , জাতীয় অনুষ্ঠান। এছাড়া আব্বুর মামার বাড়িতে আব্বুর মামাতো ভাই বোনরা সবাই মিলে গেট টুগেদার করতেন। আব্বু-আম্মাসহ আমরা চার ভাইবোন যেতাম সেই গেট টুগেদারে। আজো আমার সেই চাচা-ফুপুরা করেন, তাদের সেই বিখ্যাত গেট টুগেদার। তবে আমাদের সকলের যার যার পৃথক সংসার হয়ে যাওয়ায় এখন আর যাওয়া হয় না। আজ সেই সব শুধুই সুখ স্মৃতি।
গ্রামের আত্মীয়দের নানা কাজে শহরে আসতে হয়। বেশির ভাগই চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে। কেউ আবার মামলা মোকদ্দমার কাজেও আসেন। শহরের আত্মীয়রা তাদের পরম আদর আপ্যায়নে বাসায় রেখে তাদের শহুরে প্রয়োজন সুন্দরভাবে মিটিয়ে দিতেন। এখন অবশ্য পরিস্হিতি ভিন্ন। প্রয়োজন মেটানো দূরে থাক, গ্রামে নিজেদের বাড়ি আছে এবং সেই বাড়িতে অল্প শিক্ষিত আত্মীয়রা বসবাস করেন- এটা যেমন লজ্জার, তেমনি সমাজে নিজেদের অবস্হানকে উপহাসের করে তোলার ভয়ে আমরা সবাই গ্রাম, গ্রামের আত্মীয়দের ভুলে, ফটাফট ইংরেজি বলা মডার্ন বা আধুনিক পরিবার হয়ে গেছি। তাও রাতারাতি। অর্থ্যাৎ আমাদের কোনো গ্রাম নেই, গ্রামের আত্মীয়ও নেই।
দাদুদের সময় ১০/১২ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। আর দাদুদের বাবারা বিয়েও করতেন একাধিক। তাদের সন্তানের সংখ্যাও হতো ২০ এর অধিক। বোনেরা বিয়ে হয়ে ছিটকে পড়তেন এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। শৈশবের স্মৃতিকে পুজিঁ করে তারা তাদের জীবন কাটিয়ে দিতেন। যাতায়াত ব্যবস্হা ততো উন্নত না হওয়ায় বোনেরা একসাথ হবার সুযোগ পেতেন না বললেই চলে।
যা বলছিলাম, তো সেদিনকার সেই ভরদুপুরের রুগ্ন আত্মীয়ার জন্য আম্মা গোসলের পানি দিলেন। মা-ছেলে গোসল করে ভাত খেয়ে আমার দাদীর সাথে দেখা করতে দাদুর রুমে গেলেন। দাদু ঐ নারীকে দেখে জানতে চাইলেন- তুই কে? তিনি উত্তর দিলেন, বুজি আমারে চিনলেন না? দাদু ভাল করে তার মুখটা হাত দিয়ে ধরে দেখে অবশেষে চিনলেন। তার ছোট বোন।
দাদুদের সময় ১০/১২ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। আর দাদুদের বাবারা বিয়েও করতেন একাধিক। তাদের সন্তানের সংখ্যাও হতো ২০ এর অধিক। বোনেরা বিয়ে হয়ে ছিটকে পড়তেন এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। শৈশবের স্মৃতিকে পুজিঁ করে তারা তাদের জীবন কাটিয়ে দিতেন। যাতায়াত ব্যবস্হা ততো উন্নত না হওয়ায় বোনেরা একসাথ হবার সুযোগ পেতেন না বললেই চলে। কদাচিৎ বাবার বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো। তবে তার জন্য আর্থিক সামর্থ্য থাকাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল । দরিদ্র বোনেরা বাবার বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে আসতেন না। বাবার বাড়ি তারা আসতেন গোপনে, কোনো সাহায্যের আবেদন নিয়ে। আমার দাদুর সেই বোনটিও ছিলেন তেমনি একজন। তাই সেই সময়ের প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন ছিল- “নদীতে নদীতে দেখা হয়, বোনে বোনে দেখা হয় না।”
ক্যাটাগরি: মিনি কলাম
[sharethis-inline-buttons]