রবিবার সকাল ৬:২৭, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

নতুন ধারার সাংবাদিকতা আবশ্যক : দেশ দর্শন-পথিক নিউজ বৈঠক

শরীফ উদ্দীন রনি

পরিবর্তন অবশ্যই আনতে হবে। বর্তমানটা সমর্থনযোগ্য নয়। যদি অতীতের ধারায় ফিরে যেতে বলা হয় তাহলে সেটা নিয়েও বিস্তর কথা থাকে। আমরা কিভাবে সেটাতে ফিরে যাব, এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী ইত্যাদি।

পথিক নিউজ ডটকমের উদ্যোগে দেশ দর্শনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অফিসে “সমাজ বিনির্মাণে নতুন ধারার সাংবাদিকতা আবশ্যক” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন পথিক নিউজ সম্পাদক লিটন হোসাইন জিহাদ, প্রধান বার্তা সম্পাদক রাবেয়া জাহান তিন্নি, দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি আজম রাজু, ডেইলি অবজারভার প্রতিনিধি সীমান্ত খোকন, দেশ দর্শন সম্পাদক জাকির মাহদিন ও প্রতিবেদক শরীফ উদ্দীন রনি

লিটন হোসাইন জিহাদের সঞ্চালনায় সূচনা বক্তব্যে জাকির মাহদিন বলেন, আজ ‘নতুন ধারার সাংবাদিকতার’ প্রশ্নটি আসলো কেন? তার কারণ, প্রচলিত সাংবাদিকতায় সমাজ বিনির্মাণ ও নীতি-নৈতিকতা চূড়ান্তভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। সেটা আপনারা ভালোই জানেন। প্রচলিত সাংবাদিকতায় সাংবাদিকগণ পর্দার আড়ালে থেকে অন্যদের খারাপ-ভালোর সংবাদ পরিবেশন করেন। কিন্তু এতে তাদের নিজেদের কোনো লাভ হয় না বরং পদে পদে লাঞ্চিত-বঞ্চিত হতে হয়। সম্পাদকের ফরমায়েশ পালনে ‘দৌড়ের ওপর’ থাকতে হয়। মামলা খেতে হয়। এতে করে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকগণ হতাশাবোধ করেন। নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেন।

সাংবাদিক নিজে সরাসরি সমাজ বিনির্মাণে অবতীর্ণ হতে পারেন না কিংবা হওয়ার লক্ষ্যও থাকে না। কেবল ‘উপরওয়ালাদের’ অবহিত করেন। প্রচলিত সাংবাদিকতার নীতিমালায় কোনো সংবাদ তৈরিতে সাংবাদিক নিজের কোনো বিচার-বুদ্ধি খাটানোর সুযোগ নেই। এতে সাংবাদিকের বাস্তব শিক্ষা, জ্ঞানগত বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতা মার খায়। সম্পাদকের নির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ দৃষ্টিই প্রতিফলিত হয় এবং সংবাদ একপেশে, সংঘাতমুখী ও সেকেলে হয়ে পড়ে। তাই আমার মনে হয়, একজন সাংবাদিক নিজেকে সৎ, জ্ঞানী ও আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তিনি সংবাদ তৈরিতে নিজের দক্ষতা প্রতিফলিত করে সমাজ বিনির্মাণে আরো বেশি সক্রিয় হতে পারেন। এমনকি সরাসরি অংশ নিতে পারবেন। এটা হলুদ সাংবাদিকতার একটা বিপরীত প্রক্রিয়া।

প্রচলিত সাংবাদিকতায় সমাজ বিনির্মাণ ও নীতি-নৈতিকতা চূড়ান্তভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। সেটা আপনারা ভালোই জানেন। প্রচলিত সাংবাদিকতায় সাংবাদিকগণ পর্দার আড়ালে থেকে অন্যদের খারাপ-ভালোর সংবাদ পরিবেশন করেন। কিন্তু এতে তাদের নিজেদের কোনো লাভ হয় না বরং পদে পদে লাঞ্চিত-বঞ্চিত হতে হয়। সম্পাদকের ফরমায়েশ পালনে ‘দৌড়ের ওপর’ থাকতে হয়। মামলা খেতে হয়। এতে করে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকগণ হতাশাবোধ করেন।

সম্প্রতি এক সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা-হয়রানীর বিষয়ে একটি প্রশ্ন করা হলে জাকির মাহদিন বলেন, প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদকদের আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধা করি। কারণ তারা এতটা কাজ করেছেন বলেই এর পরের জায়গাটা নিয়ে আমরা ভাবতে পারছি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, চিন্তাক্ষেত্রে তারা খুবই পেছনে। সমাজ বিনির্মাণে তাদের ন্যূনতম অবদান নেই। বরং আজকের এই পরিস্থিতি তাদেরই সৃষ্টি। ভুল স্বীকার করাটাও এখন মারাত্মক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এর দায়ভার তাদের অবশ্যই নিতে হবে। কেননা তারা সমাজে স্বীকৃত, প্রতিষ্ঠিত, সুবিধাভোগী।

সীমান্ত খোকন দৃঢ়ভাবে বলেন, সমাজ বিনির্মাণে নতুন ধারার সাংবাদিকতার প্রয়োজন নেই, অতীতের ধারায় ফিরে গেলেই হবে। আগে রাষ্ট্রীয় সংকটে ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে সাংবাদিক-সম্পাদকদের ডেকে পরামর্শ চাইতেন। কিন্তু এখন সেটা হয় না। আগেকার সাংবাদিকদের মধ্যে মানবতা ও পেশাদারিত্ব ছিল। এখন দেখা যায়, থানাগুলোতে এবং অধিকাংশ সরকারি অফিসে কতিপয় সাংবাদিকের একটা তালিকা থাকে। তারা সেখান থেকে মাসোহারা পায় সঠিক সংবাদ না করার বিনিময়ে। আবার কোনো সাংবাদিক দুর্নীতির নিউজ করলে সেটা ছাপা হয় না। কেন, কারণ অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকা অফিস থেকে ফোন করে সেই দুর্নীতিবাজের কাছ থেকে টাকা খাওয়া হয়। একসময় সাংবাদিকদের সৎ রোজি-রোজগার কম থাকায় কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না, কিন্তু এখন পকেট গরম হওয়ার বিনিময়ে সৎ সাংবাদিকতা বিলুপ্ত।

এদিকে নতুন ধারা বলতে মূলত অতীতের সোনালী ধারাকেই বোঝানো হয়েছে এবং বর্তমান সাংবাদিকতা নষ্টদের খপ্পড়ে পড়ে এর কার্যকারিতা হারাচ্ছে বলেই ‘নতুন ধারা’ নামে একটা আওয়াজ তোলা হচ্ছে জানালে সীমান্ত খোকন এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।

লিটন হোসাইন জিহাদ বলেন, ইতিমধ্যে নতুন ধারার সাংবাদিকতা শুরু হয়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্ম সেটা করছে। আমাদের উচিত তা এগিয়ে নেয়া। চলমান নতুন ধারায় আরও নতুনত্ব প্রয়োজন। সেজন্য স্বাধীন গণমাধ্যম লাগবে। তাই আমরা পথিক নিউজ প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানে নতুনরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। নতুনদের আমরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজ বিনির্মাণের দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।

আগেকার সাংবাদিকদের মধ্যে মানবতা ও পেশাদারিত্ব ছিল। এখন দেখা যায়, থানাগুলোতে এবং অধিকাংশ সরকারি অফিসে কতিপয় সাংবাদিকের একটা তালিকা থাকে। তারা সেখান থেকে মাসোহারা পায় সঠিক সংবাদ না করার বিনিময়ে।

রাবেয়া জাহান তিন্নি বলেন, পরিবর্তন অবশ্যই আনতে হবে। বর্তমানটা সমর্থনযোগ্য নয়। যদি অতীতের ধারায় ফিরে যেতে বলা হয় তাহলে সেটা নিয়েও বিস্তর কথা থাকে। আমরা কিভাবে সেটাতে ফিরে যাব, এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, যে সাংবাদিকরা অন্যের বাকস্বাধীনতার কথা বলেন, তাদের নিজেদেরইতো বাকস্বাধীনতা নেই। প্রথমে তাদের নিজেদের স্বাধীন হতে হবে। কেউ টাকা দিলেই নেয়া যাবে না, চা দিলে খাওয়া যাবে না। সব সংবাদও দেয়া যাবে না। ‘সমাজ বিনির্মাণ’ স্লোগানকে সামনে রেখে সংবাদের বাছাই এবং সংবাদে নতুন মূল্য সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। সব সংবাদের ‘সংবাদমূল্য’ নেই।

আজম রাজু বলেন, সিনিয়র সাংবাদিকগণ মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অস্বীকার করেন। তারা শেখাবে দূরের কথা, নিজেরাই কিছু জানেন না। প্রবীণদের ওপর কোনো ভরসা নেই। সমাজপতিরা অসামাজিক, সমাজহীন, ন্যায়-নীতিহীন। আর সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে আপোষ করে চলছেন। আমরা যখন সংবাদ তৈরিতে কোনো সমাজপতির সহযোগিতা এবং সাক্ষাৎকার চাই, তারা দূর দূর করে আমাদের তাড়িয়ে দেন। সাংবাদিকগণ সমাজ বিনির্মাণ করবেন দূরের কথা, দেখা যায় তারা সেসব অসৎ সমাজপতি, রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই সংবাদ তৈরি করে। আবার আমরা যখন সংবাদের ভেতরে গিয়ে কিছু লিখি, তখন দেখা যায় তথ্য অধিকার আইন সেখানে সেন্সরশীপ আরোপ করে। সম্পাদক সেগুলো কেটে ফেলেন। সে কারণে গণমাধ্যমে জনগণের কথাগুলো ঠিকমতো আসে না। কাটছাট, বিকৃত ও একপেশে হয়ে আসে। তাই আমাদের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের বিকল্প নেই। সবাইকে ধন্যবাদ।

উল্লেখ্য যে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ এ গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন দেশ দর্শনের ওয়েব সাইট না থাকায় সেটা দেয়া যায়নি এবং বৈঠকের বক্তব্যগুলোর গুরুত্ব আজও অক্ষত থাকায় নতুন করে দেশ দর্শনের ওয়েব সাইটে প্রতিবেদন আকারে দেয়া হল। এদিকে ছবিতে উপস্থিত পাঁচজনের একজন অর্থাৎ দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনের তখনকার জেলা প্রতিনিধি আজম রাজু (ডান থেকে দ্বিতীয়) আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। গত দুবছর আগে তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। দেশ দর্শন পরিবার তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।

ক্যাটাগরি: প্রধান খবর,  শীর্ষ তিন

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply