শুক্রবার বিকাল ৪:৩২, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

দুঃখ-হতাশা থেকে মুক্তির পথ কী?

খায়রুল আকরাম খান

জীবন একটি যুদ্ধের ময়দান। এ নিরন্তর যুদ্ধে জয়ী হতে হলে শতসহশ্র বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ঠুস খেয়ে পড়ে থাকার নাম মৃত্যু, যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। ‘সমস্যাবিহীন জীবনের’ কোনো সার্থকতা বা অস্তিত্ব নেই। নিজের সমস্যাগুলোর সমাধানের পন্থা নিয়ে উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

মর্মপীড়া মানুষের এক ধরনের নেতিবাচক আবেগ। এটি মানবমনে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে। মানবজীবনের উন্নতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভুক্তভোগী নিজেকে জীবনযুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাজিত ভাবে। অতিক্ষুদ্র যন্ত্রণাও তাকে অস্থির করে তোলে। জ্ঞান ও সঠিক বোধের অভাবে সে এ গণ্ডি কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারে না। মানসিক শক্তি হারিয়ে ক্রমান্বয়ে নৈরাশ্যের দিকে ধাবিত হয়।

চরমভাবে আশাভঙ্গ ব্যক্তিরা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার উদ্যম হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবার-পরিজনের যথাযথ ভরণপোষণ এমনকি নিজের পরিচর্যা করতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদি শারীরিকক-মানসিক নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। চরম দারিদ্রে পরিবারে সবসময় ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। এ প্রতিকূল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও উদ্ধারপ্রাপ্তি সম্ভব হয়ে উঠে না। ব্যক্তিগত চরম-দুঃখ-হতাশা, পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি হয়, ডিভোর্স-আত্মহত্যার ভাবনা কাজ করে।

এ পৃথিবীতে প্রত্যেক মানবসন্তানের রয়েছে স্বাতন্ত্র্য, নিজস্বতা। পারিবারিক,সামাজিক, প্রাকৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ তার নিজস্বতাকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিছু বাস্তবজ্ঞান তার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনায় কিছু পরিবর্তন ঘটায়। এ পরিবর্তিত চিন্তা চেতনাই একসময় তার জীবন-পথের পাথেয় হয়ে ওঠে। যাদের সঙ্গে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মিল পাওয়া যায় তাদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে, গভীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। পারিবারিক-সামাজিক বা আর্থিক প্রয়োজনে বিপরীত চিন্তা-চেতনার কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে হলে পরিণামে তার মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়। নিজেকে জিন্দালাশ মনে হয়।

জীবন একটি যুদ্ধের ময়দান। এ নিরন্তর যুদ্ধে জয়ী হতে হলে শতসহশ্র বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ঠুস খেয়ে পড়ে থাকার নাম মৃত্যু, যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। ‘সমস্যাবিহীন জীবনের’ কোনো সার্থকতা বা অস্তিত্ব নেই। নিজের সমস্যাগুলোর সমাধানের পন্থা নিয়ে উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব, নিজেকে খোলামেলাভাবে উজাড় করে দিতে হবে। প্রয়োজনে আরও অন্যান্য ব্যক্তির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি সমস্যার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামগ্রিক সমস্যার মূল উৎস নিয়ে গভীর চিন্তা, প্রার্থনা এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক বা অন্যান্য কাজও সমানতালে করতে হবে।

টেনশন ও অলস বসে থাকার দ্বারা সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। মানুষের মানসিক দুঃখ-বেদনা, হতাশা-বিষণ্নতা থেকে মুক্তির কোনো পথ আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিক-বিজ্ঞানী বাতলাতে পারেননি। পৃথিবীর সমস্ত দর্শন-বিজ্ঞান সম্মিলিতভাবেও এ জায়গাটিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। তবে ধর্ম এক্ষেত্রে আশার বাণী শুনিয়েছে। ধর্ম সুখ-শান্তি এবং দুঃখ-কষ্টকে সমানভাবে গ্রহণ করার কথা বলে। যারা ধর্মবিশ্বাসী নন, তারা অন্তত পরীক্ষা করে (ধর্মের শর্তমোতাবেক) দেখতে পারেন এর সত্যতা কতটুকু। জন্মগতভাবে মানবহৃদয়কে আঘাত, অভাব, কষ্ট ইত্যাদি দ্বারা গঠন করা হয়েছে।

ইলম অন্বেষণের মাধ্যমে মানসিক শক্তি সর্বোচ্চ মাত্রায় বিকশিত করতে পারলে পৃথিবীর কোনো কষ্ট-যাতনা তাকে পরাজিত করার সাধ্য নেই। জ্ঞানশক্তি মানবহৃদয়ের প্রাচীর এত মজবুত করে, সেখানে নৈরাশ্য প্রবেশ করতে পারে না। অবশ্য এসব গুণাবলী বিকাশের জন্য ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা, সদাচরণ ও উত্তম আদর্শের অধিকারী হতে হবে। এসবের মাধ্যমে এবং সৃষ্টিচিন্তা, সৃষ্টিদর্শন, জন্ম-মৃত্যু চিন্তা ও প্রার্থনার দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করতে পারলে আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। তখন এমনকি মৃত্যুকেও (যা প্রত্যেক মানুষের জন্য অবধারিত) হাসিমুখে বরণ করা সম্ভব।

মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রবল। ধন-সম্পদের লোভে, আত্মীয়-স্বজনের আকর্ষণে, জৈবিক চাহিদা পূরণ ও প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ ভুলে যায় একদিন তাকে এই নশ্বর দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তাই পারিবারিক সামাজিক হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অন্যায়-অত্যাচার, ভোগ-বিলাস সীমাহীন গতিতে চলতেই থাকে।

পরিবেশ-বিপর্যয় ঘটছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ভ্রূণহত্যা, মানবহত্যা, যুদ্ধ ও সংঘাত। মানুষ এর লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। আমরাও এ থেকে মুক্ত নই। অনেক কিছু জেনে-বুঝেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সব মিলিয়ে আমাদের দুঃখ, হতাশা, বিষণ্নতা, কষ্ট ও অশান্তির শেষ নেই। এ থেকে আমরা কীভাবে বাঁচতে পারি এবং জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ধৈর্য, সহনশীলতায় নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারি তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে মতামত প্রয়োজন।

খায়রুল আকরাম খান : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

khirulakramkhan@gamil.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: খায়রুল আকরাম খান

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply