শুক্রবার বিকাল ৪:৪৮, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে বিশ্বের ভয়ঙ্কর সড়ক!

সীমান্ত খোকন

# রিকশাচালককে মেরে ফেলা এবং তিনজনকে আহত করা সেই বাসচালকের কথা জিজ্ঞেস করলে পুলিশ কর্মকর্তা অবজ্ঞা সহকারেই জানালেন, সে পালিয়ে গেছে। এরপরই তিনি তার মোটরবাইকের দিকে হাঁটা শুরু করেন। আমি মনে মনে বলছিলাম, সে পালিয়ে গেছে- এটি কি আরেকটি দুর্ঘটনা নয়? # প্রথম দৃষ্টিতে ঢাকা-সিলেট হাইওয়েকে (এন টু) ‘পিচঢালা মৃত্যুফাঁদ’ কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হাইওয়েগুলোর একটি মনে হবে না। পাহাড়ঘেষা সরু ও খাড়া কোনো রাস্তা নয় এটি। একটু এদিক-ওদিক হলেই বহু নিচে পাথরের ওপর পড়ে যাওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই।

রিকশার আগে আমাদের নজরে আসে বাসটি। পরিত্যক্ত অবস্থায় সেটি পড়ে ছিল রাস্তার পাশে, ইঞ্জিন তখনো সচল। রং উঠে যাওয়া বাম্পারে সৃষ্ট টোলটিই ছিল মুখোমুখি সংঘর্ষের একমাত্র প্রমাণ, যা ঘটেছিল ঠিক ১৫ মিনিট আগে। জ্যাম-ঠাসা ঢাকার শহুরে রাস্তা ছেড়েছিলাম আমি ওইদিন। একটু একটু করে এগিয়ে আমাদের গাড়ি পৌঁছেছিল হাইওয়েতে। ৫০ মিনিট না যেতেই শহুরে কোলাহল মাড়িয়ে আমাদের বিআরটিসি বাস চলে যায় সবুজের সংস্পর্শে। স্পিডোমিটারের কাঁটা সবে ওপরের দিকে উঠছিল; তখনই দেখি সেই দুর্ঘটনার চিহ্ন। রাস্তার উপর পাশে একটি মোটরচালিত তিন চাকার যানকে ঘিরে একত্রিত হয়েছিল কয়েকজন রিকশাওয়ালা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগ দেখাচ্ছিলেন তারা। এর মধ্যে একজন লোক হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আরেকজন কি মরে গেছে? সড়ক দুর্ঘটনার রিপোর্ট লিখতে থাকা ওই কর্মকার্তা জুড়ে দিয়েছিলেন উল্টে প্রশ্ন, কতজন?

রিকশাচালককে মেরে ফেলা এবং তিনজনকে আহত করা সেই বাসচালকের কথা জিজ্ঞেস করলে পুলিশ কর্মকর্তা অবজ্ঞা সহকারেই জানালেন, সে পালিয়ে গেছে। এরপরই তিনি তার মোটরবাইকের দিকে হাঁটা শুরু করেন। আমি মনে মনে বলছিলাম, সে পালিয়ে গেছে- এটি কি আরেকটি দুর্ঘটনা নয়? প্রথম দৃষ্টিতে ঢাকা-সিলেট হাইওয়েকে (এন টু) ‘পিচঢালা মৃত্যুফাঁদ’ কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হাইওয়েগুলোর একটি মনে হবে না। পাহাড়ঘেষা সরু ও খাড়া কোনো রাস্তা নয় এটি। একটু এদিক-ওদিক হলেই বহু নিচে পাথরের ওপর পড়ে যাওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। স্থুল এ পিচঢালা রাস্তাটি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দ্রুত প্রসারমান শহর সিলেটকে সংযুক্ত করেছে। বিআরটিসির ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ১৩ বছর আগে দেশের সবচেয়ে নতুন ও দ্রুততম যান চলাচলের এ রাস্তাটি নির্মাণ করা হয় ১৬৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। এর অধিকাংশ অর্থই বিশ্বব্যাংকের।

ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত গেলে চোখে পড়ে শহর, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ব্যস্ত বাজার, সবুজ ক্ষেত, বিশাল জলাভূমি এবং অসংখ্য কুড়েঘর। সঠিভাবে নির্মিত মোটরপথই মনে হয় এটিকে। দুর্ঘটনাস্থান অতিক্রম করে আবার যাত্রা শুরু করতেই অজানা আতঙ্ক কাজ করতে থাকে আমার মনে। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের পিছনের সিটে। ড্রাইভিং সিটে না বসেও পা ওপর-নিচ করা শুরু করে আমার। অন্য গাড়ি দেখে কাল্পনিকভাবে ব্রেক কষছিলাম আমি। যাত্রীবাহী বাস কীভাবে মাল নিয়ে ছুটছিল দুরন্ত গতিতে! উল্টো দিক থেকে যানকে অতিক্রম করছিল কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব নিয়ে; ছুটছিল খোলা ট্রাক মানুষ কিংবা অতিরিক্ত মাল নিয়ে। সবার গতিই ঘণ্টায় প্রায় ৯০ কিলোমিটার। একটু পরপরই কেপে উঠছিল আমাদের গাড়ির জানালা।

 

 

এসবের মধ্যেই দেখতে পাই রঙ্গিন শাড়ি পরা গার্মেন্টসকর্মীদের স্রোত। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল ছাত্ররা। বাইসাইকেল আরোহীরা আয়েশে রাস্তা ভাগাভাগি করছিল যন্ত্রের সঙ্গে। এ রাস্তায় মারা পড়া ৬০ শতাংশ লোকই পথিক, যাদের পয়সা নেই বাসে ওঠার মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২০ হাজার মানুষ। এদিকে আমাদের সরকারি উপাত্ত বলছে, এন টুতে প্রতিবছর মারা যায় ১৮০ জন, যা কিনা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে খারাপ রাস্তার তুলনায় দশগুণ বেশি। তবে রাস্তা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এ উপাত্ত বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা মনে করেন, সরকারের দেয়া উপাত্তের চেয়ে কমপক্ষে চারগুণ বেশি লোক নিহত হয় এন টুতে। যদি তাই হয়, তাহলে প্রতিদিন ভাগে পড়ে দুজন আর বছরে আহত হয় কয়েক হাজার।

একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, আন্তর্জাতিক রাস্তা মূল্যায়ন কর্মসূচির (ওজঅচ) আঞ্চলিক পরিচালক অস্ট্রেলিয়ান গ্রেগ স্মিথ মনে করেন, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার রেকর্ড খারাপ; কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন লোক। আহত হয় ৫০ মিলিয়ন লোক। এর অধিকাংশই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে। এইচআইভি ও এইডস, ম্যালিরিয়া ও ডায়রিয়াতে মিলেও এত লোক মারা যায় না। পায়ে হাঁটার রাস্তায় দশ টনের ট্রাক চালিয়ে দিলে যেমন হবে, এন টু অনেকটা তেমনই এবং তা থামাতে কেউই বেশি কিছু করছে না। তিনি বলেন, মারাত্মক ওভারটেকিং ও সংঘর্ষ এড়ানোর কোনো ব্যবস্থা নেই; নেই ফুটপাত, ওভারব্রীজ, ট্রাফিক লাইট ও গতিনিয়ন্ত্রক। মৌলিক নিরাপত্তা বৈশিষ্টগুলো ছাড়াই এ রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে। একজন প্রকৌশলী হিসেবে বলব, এটি পুরোপুরি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা। যদিও বিশ্বব্যাংকের রাস্তা এটি। উন্নতবিশ্বে এ ধরনের রাস্তা কখনোই দেখতে পাবেন না। তাহলে আন্তর্জাতিক অর্থ খরচ করে এ ধরনের রাস্তা নির্মাণ করার অর্থ কী? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, কারণ বাংলাদেশিরা দরিদ্র এবং এটি কোনো ব্যাপার না।

হাইওয়ের অদূরেই বিশাল বিলবোর্ড। কিন্তু আমার চোখে ভাসছিল দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ওই রিকশাটি আর ভাবছিলাম নিহত হওয়া রিকশাওয়ালার কথা। আচ্ছা, তার কি কোনো সন্তান আছে? একটি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে দুর্ঘটনার প্রভাব ভয়াবহ। বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার প্রতি দশটি পরিবারের সাতটিরই দুর্ঘটনার পরে পারিবারিক আয় কমে যায় এবং খাদ্যকষ্টে ভোগে। অর্ধেকেরও বেশি ঋণ নিতে বাধ্য হয়।

 

 

মোহাম্মদ আল আমিনের গল্পটাই না হয় শুনি। ২৫ বছরের এক যুবক, এন টুর পাশেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি জানান, বালক থাকা অবস্থায় এ রাস্তাটি ছিল ভাঙ্গাচোরা। ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের বেশি বেগে তখন বাস ও ট্রাক চলতে পারত না। খারাপ রাস্তা ছিল সত্য; কিন্তু ওখানে তখন কেউ মারা যেত না। একটু দূরে যেতেই কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত। ৫ বছর আগে আল আমিনের পরিবারের সদস্যরা টেম্পু চড়ে বাজার থেকে ফিরছিল। একটি বাস আরেকটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে তাদের অটো রিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। সেটি টিনের ক্যানের মতো উড়ে যওয়াতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিলেন তারা। তখন আল আমিনের বোন, মা ও বোনজামাই রনি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। রনির পা দুটি কেটে ফেলা হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল তাদের বাড়ি চলে যেতে। অথবা বিল মিটিয়ে চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসা করানো হয় বাড়ি ও জমি বিক্রি করে।

আল আমিন বলছিলেন, বাস কোম্পানি স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আমাাদের হাতে ২৫ হাজার টকা ধরিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। রাস্তা বানানোর সময় বলা হয়েছিলো, এটি আমাদেরকে ধনি বানিয়ে দিবে। মৃত্যু ও ঝুঁকি থাকলে কোনো জায়গায় দ্রুত গিয়ে কি লাভ। লোকগিজগিজ করা আশুগঞ্জের সাধারণ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে দেখা হয়েছিল ৪০ বছর বয়স্ক প্রাক্তন সৈনিক মোহাম্মদ আবদুল হান্নানের সঙ্গে। সাত বছর আগে বাস দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর থেকে তিনি হাঁটতে কিংবা কাজ করতে পারেন না। কৃত্রিম পা লাগাতে লাগাতে বলছিলেন, স্ত্রীকে বহুবার অনুরোধ করেছেন, জীবনকে উন্নত করতে তাকে ছেড়ে চলে যেতে। হান্নানকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন ডা. আবু জায়েদ। তিনি জানান, ১০ বছর আগেও এখানকার সাধারণ হাসপাতালে তারা কেবল ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা করতেন। আর এখন ৮৫ শতাংশ রোগীই আসে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে।

সীমান্ত খোকন : প্রবাসী সাংবাদিক
send2khokon@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  বিশেষ প্রতিবেদন

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply