শুক্রবার বিকাল ৪:৪২, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

ঢাকার বাইরের বিদ্যুৎ সেবার চিত্র

জিবলু রহমান

ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রাহকদের দুরবস্থা অবর্ণনীয়। বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদন নিয়ে পিডিবি থেকে যে তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয় তাতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ফলে সার-কারখানা বন্ধ করে, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নেয়ার সময় কমিয়ে দিয়েও গ্রাহকদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করা যায় না। বরং লোডশেডিং চলে যাচ্ছে আরো অসহনীয় পর্যায়ে।

আমাদের রাজনীতিকরা কখনোই নিজেদের দোষ স্বীকার করেন না। তারা অকাতরে মিথ্যা বলবেন এবং ধরা পড়ার পর হয় সেই একই মিথ্যা জপে যাবেন, অথবা কথিত মিথ্যার ব্যাপারে পুরোপুরি ‘স্পিকটি নট’, মুখে কুলুপ এঁটে থাকবেন। জাতীয় সংস্থাকে পঙ্গু বানিয়ে, কোণঠাসা করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাত দখল করে দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে ব্যাংকচেক দেয়া তাদের অব্যাহত থাকবে। জ্বালানি খাতে ‘দায়মুক্তি আইন’ দিয়ে সব অনিয়ম-দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়া হবেই। যে কোনো একটি সেক্টর নিয়ে আলোচনা করলেই সরকারের মূল পরিচালক- রাজনীতিকিদের ‘ওয়াদার বাস্তবায়ন’ সহজে বোঝা যায়।

‘নেতারা’ সাধারণত রাজধানীতে থাকেন, কচিৎ জেলাশহরে অাসেন। তাদের চাহিদা অনেক, তবে বিদ্যুৎ-চাহিদা নেই বললেই চলে। তাই তারা মুখ খুলেন না। রাজধানীতে বিদ্যুৎ ঘণ্টায় ঘণ্টায় যায়। হঠাৎ বৃষ্টি হলে ঢাকায় লোডশেডিং কিছুটা কমলেও রাতে তা আবার স্বরূপে ফিরে আসে। আর ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রাহকদের দুরবস্থা অবর্ণনীয় (বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে অচল ব্রাহ্মণবাড়িয়া)। বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদন নিয়ে পিডিবি থেকে যে তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয় তাতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ফলে সার-কারখানা বন্ধ করে, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নেয়ার সময় কমিয়ে দিয়েও গ্রাহকদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করা যায় না। বরং লোডশেডিং চলে যাচ্ছে আরো অসহনীয় পর্যায়ে।

ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ময়মনসিংহে কম্পিউটার, ফ্যান, ফ্রিজসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামাদি নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারিগরি ও যান্ত্রিক ক্রটির কারণে ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের। বিভিন্ন এলাকায় ঘন ঘন ট্রান্সফরমার জ্বলে যাওয়ার কারণেও এ লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ করা হলে সময়মতো তা মেরামত করা হয় না। জেলা শহরের এক এলাকায় বিদ্যুৎ থাকলে অন্য এলাকায় থাকে না। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলছেন, পরিস্থিতি এমন থাকলে আরেকটি কানসার্ট ঘটতে পারে। বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের উন্নয়ন কমিটির বৈঠকেও বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা কোনো কোনো এলাকায় সড়ক অবরোধ করেছেন।

শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং বেশি হয়। গ্রামে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। চাহিদা বাড়লে এ লোডশেডিংয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। অন্য যে কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির তুলনায় গ্রামে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) বিদ্যুৎ সরবরাহও কম করা হয়। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আগে আরইবির অধীন ৭২টি সমিতির মহাব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে আরইবি কার্যালয়ে এক বৈঠকে আলোচনা করা হয়। সরকারদলীয় লোকজনের নানামুখী তদবিরের চাপে ত্রাহিদশা দেশের ৭২টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। সকাল কি দুপুর, সন্ধ্যা কি গভীর রাত, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হজম করতে হয় হুমকি-ধামকি কিংবা অশ্লীল বাক্য। বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া, নতুন লাইন বিতরণ, নতুন নতুন এলাকায় বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে সবাই চায় কঠোর চাপ প্রয়োগ করে নিজেরদের কাজ অগ্রাধিকার দিয়ে করিয়ে নেয়া।

এছাড়া লোডশেডিং হলে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হলে দ্রুত মেরামত করাসহ নানামুখী চাপে অস্থির হয়ে পড়েছেন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজনৈতিক চাপ ও দুর্নীতিবাজদের আধিপত্যে অস্থির হয়ে পড়েছে পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের আওতাভুক্ত ৭২টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক তৃণমূল ক্যাডার ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী তদবিরবাজরা নিজের স্বার্থ হাসিল না হলে মাঠ পর্যায়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজারদের (জিএম) সঙ্গে চরম খারাপ আচরণ করছেন। কোথাও আবার লাঞ্ছিত হচ্ছেন অনেক কর্মকর্তা।

বিদ্যুতের উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট হচ্ছে বলে গ্রামের মানুষ জানে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ দিতে না পারলে আঞ্চলিক অফিসের সমস্যা বলে মনে করছেন গ্রাহকরা। এতদিন বিদ্যুৎ ছিল না বলে তাদের বোঝানো যেত। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। বর্তমানে সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের মোট উৎপাদনও কমেছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গড়ে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় গড়ে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দেয়া হচ্ছে গড়ে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ পাচ্ছেন আরইবির গ্রাহকরা।

আরইবির গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। আর বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু গড়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। কখনো কখনো একটু বেশিও পাওয়া যায়। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর মোট বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট চাহিদা ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি)। এর মধ্যে ডিপিডিসিকে গড়ে সাড়ে ৯০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গড়ে তারা দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং করে থাকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নয়, শুধু লাইন টানলেই হবে- এমন চিত্র পল্লী এলাকায় বেশ পুরনো। রাজনৈতিক প্রভাবে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। কনসালট্যান্টদের পরামর্শ অনুযায়ী যে এলাকা দিয়ে বিতরণ লাইন নির্মাণ করলে সমিতি লাভবান হবে, ওই এলাকায় বিতরণ লাইন নির্মাণ করা যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীদের চাপে পরিকল্পনার বাইরেও বিতরণ লাইন নির্মাণ করতে হচ্ছে।

নিচের সারির কর্মচারীরা স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। এছাড়া কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা গ্রাহকের কাছ থেকে নানাভাবে দুর্নীতি করে টাকা আদায় করলেও কর্মচারীরা কিছু বলতে পারে না। সমিতিতে বদলির নিয়ম নেই। ফলে ওই লোকদের কোথাও বদলিও করা যায় না। এটাও ওপেন সিক্রেট যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগোচরে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ চুরি হয় না বললেই চলে; যদিও গ্রামাঞ্চলে বাঁশের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের অগোচরে বিদ্যুৎ অবৈধভাবে লোপাট হচ্ছে। দেশের মিল-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যে বখরা চুক্তিতে বিদ্যুৎ চুরি করছে, তার ইঙ্গিত মিলছে সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্রতিবেদনে।

এদিকে মূল্য দিয়ে বিদ্যুৎসেবা ঠিকমতো পাওয়া না গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর রাতের আঁধার আলো ঝলমল করে তুলছে সৌরবিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ প্রায় ৩ কোটি মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার বাড়িতে নতুন করে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপিত হচ্ছে। এটি পৃথিবীর দ্রুততম ও সফলতম সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দাতাগোষ্ঠী ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) হচ্ছে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি। এই কোম্পানিই রয়েছে বাড়িভিত্তিক সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের সাফল্য অর্জন ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের ৪৭টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ‘অংশীদার সংগঠন’ হিসেবে ইডকলের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও অর্থায়নে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।

বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্থাপনের কার্যক্রম সরকারিভাবে শুরু হয় ২০০৩ সালে। তখন লক্ষ্য ছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার বাড়িকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা। কিন্তু পাঁচ বছর লাগেনি, তিন বছরেই সে লক্ষ্য অর্জিত হয়। এর অন্যতম কারণ, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিপুল আগ্রহ। এই ক্ষেত্র তৈরি করেছিল গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি। প্রতিষ্ঠানটি বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু করে ১৯৯৬ সালে। ২০০৩ সালে যখন ইডকলের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়, ততদিনে গ্রামীণ শক্তি প্রায় ২০ হাজার বাড়িতে সংযোগ দেওয়া সম্পন্ন করেছে।

সৌরবিদ্যুৎ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। সৌরবিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা ও বাজারে অনেক রাত পর্যন্ত কেনাবেচা চলছে। সেচযন্ত্র চালাতেও সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইডকলের অংশীদার সংগঠনগুলো গ্রাহকের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করে। শুরুতে গ্রাহককে মোট দামের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নগদ পরিশোধ করতে হয়। এরপর সমান মাসিক কিস্তিতে তিন বছরে অবশিষ্ট দাম পরিশোধ করতে হয় সামান্য সুদসহ। তিন বছর পর গ্রাহক বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাটির (সিস্টেম) মালিকানা স্বত্ব পান।

জিবলু রহমান : লেখক ও কলামিস্ট
jiblu78.rahman@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply