মঙ্গলবার রাত ১১:২৯, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

চিন্তার মুক্তি এক বিরতিহীন লড়াই

সমাপ্তি চক্রবর্তী

সমুদ্রের ঢেউ যেমন গুণে শেষ করা যায় না, চিন্তাও তেমনি। একটি চিন্তা তীরে এসে মিলিয়ে যায় তো আসে আরেকটি চিন্তা। যা একবার মিলিয়ে যায় তাও ফিরে আসে বারবার। তাই চিন্তা পাঠের শুরুতে সকলেরই অস্বস্তি লাগে। চিন্তার মুক্তি কঠিন, পথটিও দীর্ঘ। এর অনেক দুয়ার, অনেক তালা। একটি দুয়ারের সবকটি তালা ভাঙতেও অনেক সময় লাগে। এ এক বিরতিহীন লড়াই।

জীবন নামের কঠিন বাস্তবতা/ নিঠুর সমাজে চরম অস্থিরতা,/ অবলুপ্তপ্রায় আজ মানবতা-/ মানুষ হারিয়ে ফেলছে নিজস্বতা।/ তবুও নিশ্চুপ সর্বজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তা।/ আর কত দেখবো সমাজের বর্বরতা,/ অসহায় বিবেকের করুণ ব্যাকুলতা-/ ধৈর্যের ঘরে এখন সময়ের মৌনতা।

আসুন চিন্তাজগৎকে মুক্ত করি পূর্ব ধারণার দাসত্ব থেকে। ভেঙে ফেলি সব দুয়ার। চিন্তাজগতে সুরক্ষার নেই কোনো প্রয়োজন। কীভাবে মুক্ত হতে পারে চিন্তাজগৎ? কে চিন্তাকে বদ্ধ করেছে গণ্ডীর দুর্ভেদ্য প্রাচীরে? আশা, নিরাশা, হতাশা, চাওয়া-পাওয়া ছাড়া আর কে? যখন আশা নেই, হতাশা নেই, লোভ নেই, বাসনা নেই তখন কী আছে? আছে অহেতুক প্রেম, অকারণ আনন্দ। এই তো চিন্তার মুক্তি। চিন্তাকে জয় না করা পর্যন্ত সব জয়ই নিয়ে যায় পরাজয়ের দিকে।

অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা মানে অনিয়ন্ত্রিত জীবন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন মানে পরাজিত জীবন। চিন্তাই অভিশাপ, চিন্তাই আর্শীবাদ। একটি অশুভ চিন্তায় তিনটি অভিশাপ থাকে। প্রথমত, এটি অনিষ্ট করে চিন্তকের; দ্বিতীয়ত, এটি দূষিত করে চিন্তার বিষয়কে; তৃতীয়ত, এটি দিকভ্রষ্ট করে মানবজাতিকে। একটি শুভ চিন্তায় তিনটি আর্শীবাদও থাকে। প্রথমত, এটি উন্নত করে চিন্তকের জীবন; দ্বিতীয়ত, এটি চিন্তার বিষয়ের জন্য হিতকর; তৃতীয়ত, এটি গোটা মানবজাতির জন্য আলোর দিশারী।

সমুদ্রের ঢেউ যেমন গুণে শেষ করা যায় না, চিন্তাও তেমনি। একটি চিন্তা তীরে এসে মিলিয়ে যায় তো আসে আরেকটি চিন্তা। যা একবার মিলিয়ে যায় তাও ফিরে আসে বারবার। তাই চিন্তা পাঠের শুরুতে সকলেরই অস্বস্তি লাগে। চিন্তার মুক্তি কঠিন, পথটিও দীর্ঘ। এর অনেক দুয়ার, অনেক তালা। একটি দুয়ারের সবকটি তালা ভাঙতেও অনেক সময় লাগে। এ এক বিরতিহীন লড়াই। ছেড়ে দিলে তো হেরে গেলে। চিন্তাকে যদি মুক্ত করতে হয়, তবে প্রথমে ভাঙতে হবে বাসনার দুয়ার। এটিই প্রধান ফটক। প্রধান ফটকটি থাকে মজবুত। বারবার জন্ম, বারবার মৃত্যুর কারণ চিন্তা। যার চিন্তা মুক্ত হয়ে যায় তার জীবনও মুক্ত হয়ে যায় আসা-যাওয়ার বন্ধন থেকে।

অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা মানে অনিয়ন্ত্রিত জীবন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন মানে পরাজিত জীবন। চিন্তাই অভিশাপ, চিন্তাই আর্শীবাদ। একটি অশুভ চিন্তায় তিনটি অভিশাপ থাকে। প্রথমত, এটি অনিষ্ট করে চিন্তকের; দ্বিতীয়ত, এটি দূষিত করে চিন্তার বিষয়কে; তৃতীয়ত, এটি দিকভ্রষ্ট করে মানবজাতিকে। একটি শুভ চিন্তায় তিনটি আর্শীবাদও থাকে। প্রথমত, এটি উন্নত করে চিন্তকের জীবন; দ্বিতীয়ত, এটি চিন্তার বিষয়ের জন্য হিতকর; তৃতীয়ত, এটি গোটা মানবজাতির জন্য আলোর দিশারী।

বদ্ধ চিন্তা বদ্ধতার কারণ, মুক্ত চিন্তা মুক্তির কারণ। মুক্তচিন্তা ও বদ্ধচিন্তার পার্থক্য তেজে। বদ্ধচিন্তা দূষিত, মুক্তচিন্তা শোধিত। মুক্তচিন্তা থেকে জ্ঞানের কিরণ প্রবেশ করে আমাদের হৃদয়ে। প্রত্যেক মুক্তচিন্তা আমাদেরকে এমন কিছু জানায়, যা আগে জানতাম না। প্রত্যেক বদ্ধচিন্তা একই কথা বলে ইনিয়ে-বিনিয়ে। সেই পুরানো, সেই সন্দেহজনক কথাবার্তা- থোড় বড়ি খাড়া- খাড়া বড়ি থোড়। সেই কলার থোর, শুকনো কুমড়া-মসুর বড়ি, আর সজনের ‘খাড়া’- জীবন ছাড়া, প্রেম হারা।

এসব চিন্তাই আমাদের ঘিরে রেখেছে দশদিক থেকে। চিন্তার দূষণ ঘটে মূলত পরিবেশ থেকেই। আমাদের মধ্যে যেসব দূষিত চিন্তা রয়েছে, একটু অনুসন্ধানী হলেই বুঝা যায় এগুলো নিজের না- সবগুলো পরিবেশ থেকে প্রবিষ্ট। পরিবেশে রয়েছে মুক্তচিন্তার স্পন্দনও। মুক্ত চিন্তা দিদীপ্যমান। তার আলো ছড়িয়ে পড়ে অনেকদূর। কিন্তু যারা প্রস্তুত নয়, তারা কাছে থাকলেও বুঝতে পারে না। তাই প্রদীপের নিচেও অন্ধকার থাকে। বদ্ধ চিন্তাগুলো অন্ধকার; আলোর অনুপস্থিতি। অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে হয় না। এটি আছেই। অন্ধকার শুধু আরো অন্ধকারকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, জ্ঞান, প্রেম ও ভক্তি দ্বারা ধরতে হয় মুক্তচিন্তার দীপ্তি।

মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য একজন মুক্ত চিন্তার মানুষের ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতা ছাড়া মানুষের জন্য কিছু করা যায় না, এটি নির্বোধদের প্রলাপ মাত্র। একজন মুক্ত চিন্তার মানুষের জীবনযাপনই মানবজাতির জন্য স্পষ্ট দিশা।

হতাশা, ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিযোগিতা ও বাসনার চিন্তাগুলো খুঁজতে হয় না। ভাইরাস দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং স্তব্ধ করে দেয় জীবনের সঙ্গীত। দেহের ক্ষত যেমন ঢেকে রাখা আবশ্যক, তেমনি ঢেকে রাখা আবশ্যক চিন্তার ক্ষত। দেহের রূপচর্চার মতো চিন্তারও রূপচর্চা আবশ্যক। একজন মুক্তচিন্তক মানবজাতির জন্য কিছু না করেও অনেককিছু করে থাকেন তার চিন্তা দ্বারা। বায়ু জলকে বাষ্প করে সবার অলক্ষ্যে প্রেরণ করে আকাশে। আকাশে মেঘ জমে, মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। মুক্তচিন্তাও তেমনি। মুক্তচিন্তার প্রত্যক্ষ উপকারিতা মানুষ বুঝতে পারে না, কিন্তু মুক্তচিন্তা যদি না থাকত, পৃথিবী সুশোভিত হতো না ফুল-ফলে।

মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য একজন মুক্ত চিন্তার মানুষের ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতা ছাড়া মানুষের জন্য কিছু করা যায় না, এটি নির্বোধদের প্রলাপ মাত্র। একজন মুক্ত চিন্তার মানুষের জীবনযাপনই মানবজাতির জন্য স্পষ্ট দিশা।

মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন ডায়োজিনিস- ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। ডায়োজিনিসের ক্ষমতা ছিল না। তিনি বাস করতেন একটি পরিত্যক্ত টবে। তিনি শুধু চিন্তা করতেন। একদিন আলেকজান্ডার গেলেন ডায়োজিনিসের কাছে। ডায়োজিনিস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পরিকল্পনা কী?’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘সমগ্র গ্রীস অধিগত করা’। –‘তারপর’?- ‘সমগ্র এশিয়া মাইনর অধিগত করা’। –‘তারপর’? –‘সমগ্র পৃথিবী অধিগত করা’। -‘তারপর’?–‘তারপর আর কী! বাড়িতে বসে বিশ্রাম নেবো’! ডায়োজিনিস তখন হেসে বললেন, ‘বাপু, এ কাজটি তো তুমি এখনই করতে পার।’

সমাপ্তি চক্রবর্তী : কবি ও কলামিস্ট

কলকাতা, ভারত

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply