শনিবার রাত ১১:২৪, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

শিক্ষার সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য

সরকার জুম্মান

“বর্তমান শিক্ষার চিন্তা ও উদ্দেশ্যগত পরিবর্তন জরুরি। যখন গঠনমূলক চিন্তা সমাজে ছড়িয়ে পড়বে, তখন পরিবেশ এমনিতেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।”

শিক্ষা কী? কেন অর্জন করব? শিক্ষা এখন চলে গেছে লড়াইয়ের মাঠে। একজন আরেকজনকে প্রহার করে আর বলে, তাকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি! বাবা সন্তানের জন্য প্রশ্নপত্র কিনে তাকে সুশিক্ষা দিচ্ছেন, আলেমগণ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষা দ্বারা অর্থ উপার্জন করে তাদের সন্তানকে অর্থোপার্জনের উপযুক্ত করে তুলছেন, বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের কাছে শিক্ষা হচ্ছে- মনগড়া জীবনের আস্ফালন এবং নিজে যা বুঝে তাই ।

স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটি-মাদরাসাগুলো এখন এমন এক প্রতিযোগিতার স্থান, যা কি না মারামারি-হত্যা, আত্মহত্যা-ধর্ষণে পাল্লা দিয়ে শীর্ষস্থানে আছে। স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার, স্কুলছাত্র বন্ধুর হাতে নিহত, মাদরাসা ছাত্রের ধর্ষণ, মাদরাসা ছাত্রী ধর্ষণের শিকার, বন্ধুর সাথে ঘুরতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার- এসব শিরোনাম এখন সকালে এক কাপ কফির সাথে স্বাভাবিক নাস্তা হি‌সে‌বে প্র‌যোজ্য। উচ্চতর শিক্ষার নামে কলেজ-ভার্সিটিগুলাতে যা হচ্ছে, তা জানে না বা বুঝে না এমন মানুষ সমাজে নেই। তাই এখন খবর না নেওয়াটাই হচ্ছে সচেতনতা ।

অভিভাবকগণ সন্তান ছেড়ে দিচ্ছেন- কোনো খবর নেই। সচেতনতার আদলে তিনি স্বাধীনতা দিচ্ছেন, যা তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পূরণ করতে পারেননি। তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থাপনায় নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। তারা আসলে কী শিখছে? এটাই কি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল? যারা শিক্ষার্থী তারা কি জানে তারা কেন শিক্ষা গ্রহণ করছে? মূলত শিক্ষার উৎপত্তি কোথায় এবং এর উদ্দেশ্য কী- এদের অধিকাংশই জানে না। আর সৃজনশীলতার নামে সমাজে মুখস্থবিদ্যা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যা কস্মিণকালেও তাদের মূল শিক্ষানীতি, নৈতিকতা জাগ্রত করবে না। এখানে করবে না বলার কারণ হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা নিয়ে নোংরা রাজনীতি, নোংরা সামাজিকতা, নোংরা পারিবারিক অনুশাসন এগুলোকে অন্ধকারে আবৃত করে রেখেছে 

আরো পড়ুন> ক্ষমতাসীনরা আমাদেরই তৈরি

শিক্ষা কী? প্রথমেই দেখা যাক, শিক্ষার সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষীরা কে কী বলেছেন। জন ডিউই বলেছেন, ‌শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্মোপলদ্ধি। প্লেটোর মত হলো- শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভূক্ত। প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার। এরিস্টোটল বলেছেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যে হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা। শিক্ষাবিদ জন লকের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ।

“স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার, স্কুলছাত্র বন্ধুর হাতে নিহত, মাদরাসা ছাত্রের ধর্ষণ, মাদরাসা ছাত্রী ধর্ষণের শিকার, বন্ধুর সাথে ঘুরতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার- এসব শিরোনাম এখন সকালে এক কাপ কফির সাথে স্বাভাবিক নাস্তা হি‌সে‌বে প্র‌যোজ্য। উচ্চতর শিক্ষার নামে কলেজ-ভার্সিটিগুলাতে যা হচ্ছে, তা জানে না বা বুঝে না এমন মানুষ সমাজে নেই। তাই এখন খবর না নেওয়াটাই হচ্ছে সচেতনতা।”

বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ। কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেল এর মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি। কমেনিয়াসের মতে, শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে- সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা। পার্কার বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্মপ্রকাশের জন্যে যেসব গুণাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন। জ্যাঁ জ্যাক রুশোর মতে, সুঅভ্যাসে গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এগুলিই হচ্ছে শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের উক্তি, যারা আসলে মন দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের আশা করতেন।

ধর্মের কথা বললে তো কারো পায়ের নিচে মাটি থাকবে না, যে কারণে সমাজে আস্তিক-নাস্তিক এত বাকবিতণ্ডা। কেউ কাউকে আদর্শরূপে পাচ্ছে না। উপরের শিক্ষার সংজ্ঞাগুলোয় কি কোথাও অর্থ-বিত্ত অর্জন ও অহংকার প্রদর্শনের লেশমাত্র পাওয়া যায়? তার মানে প্রকৃত শিক্ষা কোথায়, আর আমাদের চিন্তা কোথায়? তারা শিক্ষা কোথায় খুঁজেছেন, আর আমরা শিক্ষাকে কী মনে করছি। জিপিএ-৫ পাওয়া একটা স্টুডেন্ট বলতে পারে না জিপিএ, এসএসসি, এইচএসসির পূর্ণরূপ। যেখানে অষ্টম শ্রেণি পাস করে কবি নজরুল মাস্টার্সের কবিতা লিখতেন, সেখানে আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আমাদের শিক্ষার ফারাক?

লেখকের সব লেখা

এগুলো কী তৈরি হচ্ছে? এক সময় শিক্ষা বলতে ছিল, নীতি-নৈতিকতার উন্নতি, অহংকারের পতন। ছোটবেলায় গল্প শুনতাম, রাজা তার সন্তানদেরকে ওস্তাদের কাছে দিয়েছে শিক্ষার জন্য এবং রাজপুত্ররা ওস্তাদের পা ধুয়ে জুতো পরিয়ে দিতেন। এই তো  ক‘দিন আগেও পায়ে ধরে সালাম করে শ্রদ্ধা জানানোর রেওয়াজ ছিল। যদিও এটা ঠিক না, তারপরও একটা যুগ ছিল শিক্ষা মানুষকে সম্মান দেয়া শেখাতো। অহংকার বিলীন করে দিত। আর আজ শিক্ষা দ্বারা শিক্ষিত হয়ে শিক্ষককে পেটাচ্ছে, অপমান-অপদস্থ করছে। এখনো আমাদের চিন্তায় আসে না, এই শিক্ষা আমরা নিজেরা শিখে এবং সন্তানকে দিয়ে আমরা কী আশা করছি?

শিক্ষা যদি আমার স্বভাব পরিবর্তন না করে তবে তা অযথা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়! এরচেয়ে সন্তানকে ওয়ার্কশপে ফেলে রাখা ভালো। অন্ততপক্ষে মেশিনের উপর তার শক্তির ব্যবহার কাজে লাগবে। যে শিক্ষা ব্যবহারিক বিষয়গুলোকে সামনে রেখে হবে, সে শিক্ষা দ্বারা নিজে, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বমানবতায় কোনো কাজে আসবে না বরং ক্ষতি। তাই বর্তমান শিক্ষার চিন্তা ও উদ্দেশ্যগত পরিবর্তন জরুরি। যখন গঠনমূলক চিন্তা সমাজে ছড়িয়ে পড়বে, তখন পরিবেশ এমনিতেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

সরকার জুম্মান: সাংবাদিক ও লেখক

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: সরকার জুম্মান

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply