শুক্রবার বিকাল ৩:২২, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

উপমহাদেশের মুসলিম সংস্কৃতিতে হিন্দুত্ববাদের মিশ্রণ

এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তার ব্যবধান ছিল অনেক। ফলে সামাজিকভাবে এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে যতখানি পারস্পরিক লেনদেন হবার কথা ছিল, তা কখনো হয়ে উঠেনি। হিন্দু-মুসলমানের এই সামাজিক ব্যবধান শুরু থেকেই ধর্মীয়-রাজনীতির অস্বাস্থকর চেতনার বীজ উভয়ের মস্তিষ্কে বপন করে, যা ইংরেজদের আর্বিভাবের পূর্বেই সূচীত হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনে উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবধানকে সক্রিয় প্রচেষ্টায় পরিণত করছে রাজনৈতিক বিরোধে। এই পরিণতির নামই সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা ভারতবর্ষে জীবন যাত্রার যে নতুন আয়োজন করল তাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে কিন্তু এগিয়ে এলো না।

আবহমান বাঙলার সভ্যতা সংস্কৃতির ইতিহাস সুপ্রাচীন। কিন্তু কারা এই সভ্যতার রূপকার? এ প্রশ্নের এখনো মিমাংসা করা না গেলেও, প্রমাণ হয় যে এখানে হাজার হাজার বছর আগে বসতি ছিল। আজ যে বাংলাদেশ, বঙ্গভূমি, বাঙালি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়, এর ধারণা সে কালে ছিল না। এ ধারণাগুলো গড়ে উঠেছে অনেক পরে, খ্রিস্টের জন্মেরও পরে। প্রাচীনকালে যেসব নাম পাওয়া যায় তা হলো- বঙ্গ, গৌড়, সমতট, হরিকেল,পুন্ড্র, রায়, বরেন্দ্র, গঙ্গাহৃডি প্রভৃতি।

আজকের যে বঙ্গদেশ (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) তা এককালে নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। বঙ্গ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ণ, মহাভরত, হেমচন্দ্রের অভিধান ‘চিন্তামনি’ প্রভৃতি গ্রন্থে। পলি সাহিত্যের বহু স্থানে বঙ্গ নামটির উল্লেখ আছে। বঙ্গভূমি নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন জনপদ বিভিন্ন নামে গড়ে উঠে। পাঠান আমলে বিভিন্ন জনপদের মধ্যে ঐক্যপ্রয়াসের ঘটনা ঘটে এবং মোঘলযুগে তা বিস্তৃতি লাভ করে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সর্বপ্রথম বাংলা শব্দটি গোটা দেশের নাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে দেশের নাম সুবা বাংলাহ বলা হয়। ইউরোপের পর্যটকরা বিশেষ করে পুর্তুগীজরা দেশকে অভিহিত করেছে ‘বাংলা’ নামে। লর্ড কার্জনের সময়ে ইস্ট বেঙ্গল কথাটি ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ বা বাংলা আর ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাক-ভারত উপমহাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক গঠন অনুসারে ভারতবর্ষের তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনযন্ত্র পরিচালিত হয়েছিল যেমন পাল-সেন রাজন্যবর্গ দ্বারা, তেমনই সুলতান ও নবাবরাও এই বাংলাকে শাসন করেছিল একক কর্তৃত্বে। নিম্ন হিন্দুরা যেমন শোষিত হয়েছে, তেমনই শোষিত হয়েছে মুসলমানেরাও। যেহেতু ওসব সমাজ-ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ছিল পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠির একাংশ।

একই সঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তার ব্যবধান ছিল অনেক। ফলে সামাজিকভাবে এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে যতখানি পারস্পরিক লেনদেন হবার কথা ছিল, তা কখনো হয়ে উঠেনি। হিন্দু-মুসলমানের এই সামাজিক ব্যবধান শুরু থেকেই ধর্মীয়-রাজনীতির অস্বাস্থকর চেতনার বীজ উভয়ের মস্তিষ্কে বপন করে, যা ইংরেজদের আর্বিভাবের পূর্বেই সূচীত হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনে উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবধানকে সক্রিয় প্রচেষ্টায় পরিণত করছে রাজনৈতিক বিরোধে। এই পরিণতির নামই সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা ভারতবর্ষে জীবনযাত্রার যে নতুন আয়োজন করেছিল তাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই কিন্তু এগিয়ে আসেনি। নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হলো অনেকখানি।

ইংরেজরা তাদের পূর্ববর্তী হিসেব অনুযায়ী হিন্দু এবং মুসলমানদের সুনজরে দেখলো না। উপরতলার মুসলমান সমাজে তাই দেখা দিল ক্ষয়িষ্ঞুতার লক্ষণ। তারা বন্দী হলো পশ্চাদপদতার নাগপাশে। আর হিন্দুরা খুঁজে পেল নিজদের, খাপ খাইয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল ইংরেজদের সাথে। মুসলমানরা তা পারেনি। ফলে রাজনৈতিক পারজয়ের গ্লানি বাঙালি মুসলমানকে যেভাবে বিধ্বস্ত করেছে, সমগ্র ভাররতবর্ষের অন্য কোথাও তা হয়নি।

ইংরেজপূর্ব যুগে ভারতবর্ষে শ্রমবিভাগ ছিল শ্রম-নির্ভর। ইংরেজরা এ দেশের ধনতন্ত্রের বীজ বপন করে শ্রম বিভাগ করল জন্ম নিরেপেক্ষ। হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেদের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করল এবং মুসলমানদের পিছিয়ে রেখে অনেকখানি এগিয়ে গেল। সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মসলমানের মধ্যে পার্থক্যের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল, সে চেতনা ভারতীয় ধনতন্ত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রসার ও অগ্রগতির সাথে ভরতীয় রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে সৃষ্টি করল এক কুৎসতি জটিলতা। আর এই জটিলতার নামই সাম্প্রদায়িকতা। সাম্পাদায়িক সম্প্রীতিহীন মুসলিম সমাজ হিন্দু সমাজের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল শুরু থেকেই। আবার হিন্দুদের ঐক্যের ফলে সরাসরি প্রতিযোগিতায় মুসলমানরা দ্রুত উন্নতির ভরসাও পেল না।

১৭৫৭ সালে সিরাজের পতন এ দেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রাজার প্রস্থান ও অন্য রাজার অনুপ্রবেশই শুধু নির্দেশ করেনি, এতে এ উপমহাদেশের ইতিহাসের হাজার বছরের অতীত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতির একটা ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। শস্য-শ্যামল এ সোনার বাংলাকে তখন বলা হতো স্বর্ণ প্রসবণী। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতির ভাণ্ডারও ছিল বিত্ত-বৈভবে পরিপূর্ণ। বৃহত্তর বাংলার মতো এত বড় দেশ হাতে পাওয়ায় অর্থলোলুপ বেনিয়া কোম্পানির লোকদের লোভের ও শোষণের মাত্রা আরো বেড়ে উঠে। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হয়ে উঠে বর্ণনাতীত। কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এ সময়েরই ফল। বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দ মঠে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও কলঙ্কময় ইতিহাস সৃষ্টির মাধ্যমে ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে রাজশক্তি ছিনিয়ে নেয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানরাও যেমন ইংরেজদের সুনজরে দেখতে পারেনি, ইংরেজরাও তেমনি মুসলমানদের দেখেছে সংশয়, সন্দেহ ও অত্যাচারের দৃষ্টিভঙ্গিতে। নজরুল-তীতুমিরের ইংরেজ-বিদ্বেষও তাদের উপর নির্যাতন-জুলুমের কারণ। কিন্তু এ কথা সত্য, যে কোনো দেশের রাজশক্তি যত বড় হোক না কেন, শাসিতদের সমর্থন ও আনুকুল্য ব্যতীত তা দীর্ঘকাল টিকতে পারে না।

মুসলমান এবং ইংরেজদের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব-সংশয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান, তখন নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য এ দেশের হিন্দু সমপ্রদায়কে হাত করার এবং তাদের চিত্ত জয় করার সাধনা চালালো ইংরেজ হঠকারীরা। একে তো মুসলমানেরা হারালো রাজশক্তি। তদুপরি এ দেশের শাসনব্যবস্থা হাতে পাওয়ার পরপরই এ দেশে নিজেদের অবস্থান দৃঢ়, প্রতিষ্ঠিত ও আর্থিক উন্নতি সাধনের জন্য ইস্টইন্ডিয়ার লোকেরা যে কয়টি বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেছিল, তার সব ক’টি গিয়েছিল মুসলমানদের স্বার্থের বিপক্ষে, প্রতিকূলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার প্রবর্তন ও নিষ্কর জমির বাজেয়াপ্তির পর দেখা গেল জমির মালিক মুসলমানরা হল নিঃস্ব এবং প্রজা ও মুসলমান ভূম্যাধিকারীর মধ্যবর্তী তহশিলদার, নায়েব, মুহুরী ও গোমস্তা প্রমুখ হিন্দু কর্মচারী ইংরেজদের অনুগ্রহে অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যে হয়ে উঠল ভূস্বামী।

এদিকে পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত রাজধানী মুর্শিদাবাদই ছিল সমগ্র বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। যার অনেকটাই ছিল মুসলমানদের জন্য অনুকূলে। রাজশক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক জীবন নিঃশেষিত হয়ে নতুন গড়ে উঠা রাজধানী কলকাতায় নতুন সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক এতকালের সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানদের যে প্রাধান্য তা আর রইল না। রাজ আনুকূল্যে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকল এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র আচার অনুষ্ঠানগুলিতে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে হিন্দু ধারার রীতি-নীতির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকল এবং অনেকটা হিন্দু আদলে আচার অনুষ্ঠানগুলি পালিত হতে থাকল। যদিও এর জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সুদৃঢ় প্রসারতার অভাব, অসচ্ছ মনোভাব এবং অপব্যাখ্যাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী।

মুসলমানদের সামাজিক পর্বগুলির মধ্যে ইসলাম ধর্মের একটি সংযম ও শালীনতার দৃঢ় বন্ধন আছে বৈকি। তথাপি মহররমের জাকজমকপূর্ণ যে উল্লাস, তা হিন্দু পূজোপার্বণগুলির অনেকটা অনুসরণ। এ ছাড়া এর তাজিয়া নির্মাণ এবং দশম দিবসে মঞ্জিল, তাও দূর্গা পূজার প্রতিমা গঠন ও দশমির দিনে বিসর্জনের মতো। হিন্দুদের গরু-পূজা, মুসলমানদের পীর-পূজা, পীরের দরগায় উরস এবং ওলী-আওলিয়াদের মাজারে অতিরিক্ত জিয়ারত শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে হিন্দুদের তীর্থস্থানের মতো করে তোলা, বাংলাদেশে অশিক্ষিত ও গ্রাম্য মুসলমান সমাজে হিন্দুদের পৌরাণিক সমুদ্র দেবতার মতো খোয়াজ খিজিরকে মেনে চলা, তাঁকে লক্ষ্য করে ফাতেহা পড়ে হিন্দুদের পূর্ব পুরুষদের নামে স্মৃতি-তর্পনের নামে নদীতে পয়সা-মিষ্টান্ন তর্পণ করা, হিংস্র বন্য পশুদের উপড়ে ও পীরের মাহাত্ম স্বীকার করে পীরের সাহায্যে হিংস্র পশুদের শান্ত রাখা এবং তাদের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আত্মপ্রসাদ প্রভৃতি রীতি-নীতি ভারতীয় ইসলামে তথা বাঙালি মুসলিম সমাজজীবনে হিন্দু প্রভাবজাত।

সুন্দরবন অঞ্চলে মুসলমানদের এক পীর ছিলেন জিন্দাহ গাজী বা কালু গাজী। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মাঝে মুসলমানদের এই পীর কালু রায় নামে পরিচিত। কলেরা ও বসন্তের কু-গ্রহ থেকে বাঁচার জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও একই কায়দায় শীতলা দেবী ও ওলা বিবির নামে প্রসাদ শিরনি দেওয়ায় বিশ্বাস করত। মধ্য যুগের বাংলার কবি সাহিত্যিকদের বহু রচনায় এসবের সমর্থন পাওয়া যায়। তাছাড়া মুসলমানদের বিবাহে পণপ্রথা প্রবর্তন এবং টাকা পয়সা আদান-প্রদান হিন্দু সমাজেরই অনুকরণ। বাংলা তথা ভারতীয় ইসলামে ও মুসলিম সমাজে এ ধরনের হিন্দু প্রভাব মুনলিম আমল থেকেই অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল।

মুসলমানদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা খসে গেলে শিক্ষা ও তবলিগের অব্যবস্থার ফলে তাদের মধ্যে এ অন্ধ মানসিকতা এবং কুসংস্কার দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। কালের প্রবাহে, চেতনার সঠিক টানে সমাজ ও জাতীয় জীবনে এহেন অ-ইসলাম বা হিন্দু প্রভাব প্রশ্রয় পাওয়াকেই মুসলমানরা তাদের সমস্ত ভাগ্যহীনতার কারণ বলে নির্দেশ করে। তাঁদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সর্ববিধ বেদাত-শেরেকমুক্ত ইদিম ও অকৃত্রিম ইসলামের পূনঃপ্রর্বতনই যে তার একমাত্র উপায়, এ বিশ্বাস থেকেই তখন বাংলার মুসলমানেরা তাদের ধর্ম সংস্কারের দিকে মন দেয়। সে থেকে নানা চড়ায়-উৎরায় পেরিয়ে অসংখ্য মত-পার্থক্য ও ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণ। নানা ক্রটি-বিচ্যুতির মধ্য দিয়েও সে ধারাবাহিকতা আজো বিদ্যমান।

আমির হোসেন : কবি ও কথাসাহিত্যিক

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply