এখন জনগণ যেমন তাদের জামাই আদর করে, সরকারও তাদের বিশেষ কিছু লোকের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। পাইকারিভাবেও অনেকে এ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই ‘ঈমানী তেজ, জযবা বা পাওয়ার’ নেই। আত্মমর্যাদাবোধ, ইখলাস, সততা, জ্ঞানগভীরতা ও ঐক্য নেই। রাজনীতির মাঠে তারা এখন ছিন্নভিন্ন।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-৩ :: বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গায় এসে উপনীত হয়েছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে ‘আলেম’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিগণ এবং তাদের অনুসারীরা। নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি ক্রমাগত বাড়ছেই। নৈতিক স্খলন, ধর্মীয় উগ্রতা বা সংকীর্ণ মনোভাব এ বিচ্ছিন্নতা এবং বিভক্তি আরো ত্বরান্বিত করছে। কোনোভাবেই এসব থামানো যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে অনেক মূলধারার কওমিপন্থী আলেমই এ প্রতিবেদককে চরম হতাশার কথা জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকগণ এর কারণ হিসেবে বলছেন, ধর্মীয় মূলধারার শিক্ষায় অনুসন্ধানের অভাব, দুনিয়ামুখী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, গবেষণা ও উদার মানসিকতার অভাবই এজন্য মূলত দায়ী। তারা বলেন, আজকাল দেখা যায় যারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন, তারা প্রথমে নিজেদের ডিগ্রিটাই উঁচিয়ে ধরেন এবং এটা দিয়ে প্রথমত বিদেশে সুযোগ, ভালো একটা চাকরি বা রুটিরুজির বিষয়টিই নিশ্চিত করেন। তারা উঁচু মাকামে বসে নবী (সা.) ও সাহাবীগণের (রা.) যে দুনিয়াবিমুখ, কথিত শিক্ষাহীনতা ও কষ্ট-কোরবানীর বয়ান করেন তার সঙ্গে স্বয়ং ওয়ায়েজ বা বক্তার যোজন যোজন দূরত্ব। এতে করে সমাজের সাধারণ মানুষের মনে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। আর শিক্ষিত শ্রেণি ধর্মের প্রতি দিন দিন শ্রদ্ধা হারাচ্ছে।
তারা বলছেন, একটা সময় ছিল যখন ‘আলেম-ওলামা’ বলতেই সাধারণ মানুষের নিকট বিশেষ শ্রদ্ধাপূর্ণ ছবি ভেসে ওঠত। সামাজিক ও সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণও আলেমদের প্রবল শ্রদ্ধা করতেন। মাদরাসা-মসজিদের খেদমতে নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে চেষ্টা করতেন। যদিও তখনো সমাজব্যবস্থার পূনর্গঠনে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি বা আর্থরাজনৈতিক বিকল্প শক্তি এবং চ্যালেঞ্জিং পথ-পদ্ধতি দিতে পারেননি। ‘নাস্তিক’ হয়ে যাবার ভয়ে চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থনীতি থেকে তখনো ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রাখতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ভাল ছিলেন এবং সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। কিন্তু আজ এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে এবং ধর্মকে আশ্রয় করে অনেকেই বড় বড় টাইটেল এবং গাড়ি-বাড়ির প্রতি অতি মনোযোগী।
বিশ্লেষকগণ আরো বলেন, একসময় সরকারি সুযোগ-সুবিধা দূরের কথা, জনগণের সাহায্য-সহযোগিতাও ঠিকমতো না পাওয়া কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে অঘোষিত নেতা ছিলেন। তাদের অঙ্গুলি হেলনে মুহূর্তে কেঁপে উঠত রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্তাব্যক্তিদের মসনদ। বিশেষ কিছু ইস্যুতে তারাও ছিলেন ঐক্যবদ্ধ। যে কারো কাছ থেকে কেবল ‘ঘোষণা’ আসলেই সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত (যদিও বিষয়টি সরলভাবে সমর্থনযোগ্য নয়)। কিন্তু আজ আর সে দিন নেই। এখন জনগণ যেমন তাদের জামাই আদর করে, সরকারও তাদের বিশেষ কিছু লোকের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। পাইকারিভাবেও অনেকে এ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই ‘ঈমানী তেজ, জযবা বা পাওয়ার’ নেই। আত্মমর্যাদাবোধ, ইখলাস, সততা, জ্ঞানগভীরতা ও ঐক্য নেই। রাজনীতির মাঠে তারা এখন ছিন্নভিন্ন।
আজকাল দেখা যায় যারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন, তারা প্রথমে নিজেদের ডিগ্রিটাই উঁচিয়ে ধরেন এবং এটা দিয়ে প্রথমত বিদেশে সুযোগ ভালো একটা চাকরি বা রুটিরুজির বিষয়টিই নিশ্চিত করেন। তার উঁচু মাকামে বসে নবী (সা.) ও সাহাবীগণের (রা.) যে দুনিয়াবিমুখ, শিক্ষাহীনতা ও কষ্টকোরবানীর বয়ান করেন তার সঙ্গে ওয়ায়েজ বা বক্তার যোজন যোজন দূরত্ব।
সাম্প্রতিক রাজনীতিতে দেখা যায়, একজন সাবেক জনবিচ্ছিন্ন মন্ত্রী কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিষোদ্গার করলে কওমিগণ তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন করেও কিছুই করতে পারেননি। আবার মিডিয়ায়ও আলেমদের প্রচলিত ওয়াজ নিয়ে নেতিবাচক ধারাবাহিক প্রতিবেদন হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও ছলে-বলে-কৌশলে ধর্মপন্থী ও আলেমদের দিয়ে সরকারের কথিত বিভিন্ন ‘উন্নয়নমূলক’ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি নিয়ে নিচ্ছে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বে ঠেলে দিচ্ছে। তাবলীগে চলমান সংঘাতই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তাছাড়াও ধর্মীয় উৎসব ও বিশেষ দিনগুলোর সময় এবং ব্যাপকতা নিয়েও আলেমদের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
দেশ দর্শনের বিশেষ অনুসন্ধানে আরেকটি সমস্যা বেরিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে, তরুণ আলেমদের শিক্ষা এবং চিন্তাগত জ্ঞান-গভীরতা খুবই কম। অথবা এক্ষেত্রে তারা একেবারেই সময় দেন না। তাই প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলগুলোতে দেখা যায়, উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে বরং উঁচুগলায় সরকার ও নাস্তিকদের হুঁশিয়ার করে বক্তব্য দেয়া হয়। এতে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে হলেও উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে তরুণ আলেমদের বিশাল একটা সংখ্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয়। তারা সমস্যার মূল ধারাগুলো চিহ্নিত করতে চেষ্টা না করে বরং তাদের বিরোধী মত-পথের মানুষদের বিভিন্নভাবে স্ট্যাটাসে ও কমেন্টে কটাক্ষ করেন, নাস্তিক, মুরতাদ, দালাল- এ জাতীয় অতিপরিচিত উপাধিগুলো তারা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেন। এমনকি ইসলামবিরোধীদের পেইজ ও স্ট্যাটাসে গিয়ে তারা উগ্রবাদী কমেন্ট করেন। এতদিন যা ধর্মীয় একটা বিতর্কিত রাজনৈতিক দলের তরুণ সমস্যগণ করে এসেছে এবং ফল হয়েছে হিতে বিপরীত।
চলবে…
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-২ “আরো দেড়শো ইসলামি দল মাঠে আসছে”
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-১ “নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা দাবার গুটি, মূলশক্তি নয়”
ক্যাটাগরি: প্রধান খবর, শীর্ষ তিন
[sharethis-inline-buttons]