শুক্রবার রাত ২:৩২, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

আমাদের মালিকানা সীমাবদ্ধ, অস্থায়ী ও অনিশ্চিত

জুনায়েদ আব্দুল্লাহ গালিব

সীমিত ও অস্থায়ী মালিকানা এবং চূড়ান্ত ও স্থায়ী মালিকানায় অনেক ফারাক। তাহলে ব্যক্তি নিজেই যেখানে তার শরীরের স্থায়ী মালিক নন, কিভাবে তিনি তার শরীর দান করেন?

আমাদের অনেকেরই অনেক কিছু রয়েছে- গাড়ি, বাড়ি, শাড়ি, টাকা, জমি। সচরাচর আমরা বলি, আমরা এগুলোর মালিক। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মালিকানার বিষয়টি বেশ জটিল। প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো কিছু আইনগতভাবে অধিকৃত করার, রাখার বা ভোগ করার সুবিধাকেই মালিকানা বলে। এর পাশাপাশি কোনো বস্তু বা বিষয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, ভোগ, ভরণপোষণ, নির্দেশন করতে পারলে সেই বস্তু বা বিষয়টি আমার অধিকৃত বলে বিবেচিত হবে। যেমন আমার একটি গাড়ি রয়েছে। গাড়ি কেনার সময় চুক্তিনামায় মালিক হিসেবে আমার নাম। আমি স্বাক্ষর করেছি। কাগজে কলমে আমি এই গাড়ির মালিক। আমি গাড়ির সুবিধা ভোগ ও ভরণপোষণ করছি বিধায় আমি মালিক বলে বিবেচিত হচ্ছি। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি গাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে। এতদসত্ত্বেও গাড়িতে পাখির বিষ্ঠা ত্যাগ থেকে শুরু করে দাগ-ময়লা, ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে। আমি মালিক হয়েও তা ঠেকাতে পারছি না। দুর্ঘটনা থেকে আমার গাড়িকে আমি বাঁচাতে পারছি না, পারবও না। আপনিও আপনারটা পারবেন না। এ কারণেই ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা চাঙ্গা।

আমাকে যে কোম্পানি গাড়ির মালিক বানালো, সেই কোম্পানিরই সঙ্গী ইন্সুরেন্স কোম্পানি বলছে, আমি মালিক হলেও দুর্ঘটনা ঠেকাতে পারব না। আমি মালিক হিসেবে যথেষ্ট না। তাই আরো উপরি পয়সা দেয়া লাগবে। গাড়িটি যে কোনো কারণে অকেজো হয়ে গেলে আমি মালিক হিসেবে সেটিকে পরিত্যাগ করতে পারি। কিন্তু আমি অকেজো হয়ে গেলে বা আমার মৃত্যু হলে গাড়িটি আর আমার থাকবে না বরং আমি মালিকানাচ্যুত হব। এটা অনেকটা ভাড়ায় পাগড়ি বা শেরওয়ানি নেবার মতো, অস্থায়ীভাবে অধিকৃত। আবার আমার পদ্মাপাড়ের জমি সরকার আইনিভাবেই অধিগ্রহণ করতে পারে, যুদ্ধাবস্থায় সরকার নিয়ে নিতে পারে অথবা পদ্মায় তলিয়ে যেতে পারে। আমার মৃত্যু হলে তো কথাই নেই, উত্তরাধিকারিরা ভোগ করবে। বাস্তবিকই আমার মালিকানা সীমাবদ্ধ, অস্থায়ী, অনিশ্চিত।

গাড়িতে পাখির বিষ্ঠা ত্যাগ থেকে শুরু করে দাগ-ময়লা, ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে। আমি মালিক হয়েও তা ঠেকাতে পারছি না। দুর্ঘটনা থেকে আমার গাড়িকে আমি বাঁচাতে পারছি না, পারবও না। আপনিও আপনারটা পারবেন না। এ কারণেই ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা চাঙ্গা।

অনেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষা ও গবেষণার নিমিত্তে মরণোত্তর দেহ দান করেন। এ জাতীয় অঙ্গীকারনামায় ব্যক্তি নিজেই নিজের দেহের মালিক হিসেবে স্বাক্ষর করেন। আগে যা বললাম, সে অনুসারে ব্যক্তি মৃত্যুর আগে সীমিত পরিসরে নিজের দেহের মালিক। ‘সীমিত’ বলছি, কারণ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও গাড়ির মতো ব্যক্তি নিজের শরীরটাকেও ক্ষয়-দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারে না। তাহলে ব্যক্তি নিজেই যেখানে তার শরীরের স্থায়ী মালিক নন, কিভাবে তিনি তার শরীর দান করেন?

সীমিত ও অস্থায়ী মালিকানা এবং চূড়ান্ত ও স্থায়ী মালিকানায় অনেক ফারাক। আমি মনে করি, বাস্তবতার আলোকে মানুষের ‘মালিকানা’ না হয়ে ব্যাপারটা হতে পারে ‘অস্থায়ী বা সীমিত অধিকার’। অথবা অধিগ্রহণ বা ধারণ। কেননা চূড়ান্ত, সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী না হলে মালিকানা অর্থপূর্ণ হয় না। এই আংশিক, সীমিত এবং অস্থায়ী মালিকানাকে ঘিরেই যতসব যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, রক্তপাত, শাসন-শোষণ, জুলুম, অন্যায় চলছে। সম্পত্তি, সুবিধা, ভোগ, পদবি, ক্ষমতা ইত্যাদির মালিকানা দখলই আজকের বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রধান কারণ। প্রত্যেকটি মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী মালিকানা কামনা করে। প্রবৃত্তির অন্তর্গত দুই ধরনের চাহিদার মাঝে প্রচণ্ড পার্থক্য বিদ্যমান। বেঁচে থাকার জন্য দৈনন্দিন জৈবিক কার্যকলাপ, শ্বাসক্রিয়া, পরিপাকক্রিয়া, খাদ্য-পানীয়, জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদি আমাদের ডিএনএর অন্তর্গত সত্তাগত স্বভাবজাত চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে লোভ বা কামনা আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ, শিক্ষার ফলাফল। সোজা কথায়, অন্যের কি আছে না আছে, জীবনের কোন পর্যায়ে কিসের কিসের মালিকানা থাকতে হবে ইত্যাদি ধারণা নিয়ে আমরা জন্মাই না। মালিকানার যত আস্ফালন সব এই লোভ বা কামনাকেন্দ্রিক।

অথবা অধিগ্রহণ বা ধারণ। কেননা চূড়ান্ত, সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী না হলে মালিকানা অর্থপূর্ণ হয় না। এই আংশিক, সীমিত এবং অস্থায়ী মালিকানাকে ঘিরেই যতসব যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, রক্তপাত, শাসন-শোষণ, জুলুম, অন্যায় চলছে। সম্পত্তি, সুবিধা, ভোগ, পদবি, ক্ষমতা ইত্যাদির মালিকানা দখলই আজকের বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রধান কারণ।

রাজনীতিতে যার ক্ষমতা যত দীর্ঘ তার আকুলতাও তত বেশি, ততোধিক মালিকানা হস্তগত করার কামনায়। এক্ষেত্রে মালিকানার চাহিদায় সবসময় তুলনাগত এবং আপেক্ষিক গ্যাপ বা কমতি থেকে যায়। আমরা জানি, বিশ্বের যে কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দাফতরিক ক্ষমতার তুলনামূলক বিচারে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। তারপরও আমরা সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে আকারে ইঙ্গিতে বলতে শুনেছি এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলে থাকেন কিভাবে সংসদকে টপকে প্রেসিডেন্ট এটা ওটা করতে চান এবং সুযোগ পেলেই করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাবৎ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতির দফতরের ক্ষমতার মালিকানায়ও ঘাটতি দেখা যায়; সেখানেও মালিকানা সম্পূর্ণ না।

যে মালিকানা অসম্পূর্ণ, যে মালিকানা অর্থপূর্ণ না, তাকে ঘিরে এত কিছু! বড় পরিসরে চিন্তা করলে খুঁজে পাওয়া যায়, এই মহাবিশ্বের সবকিছু একই উপাদানে সৃষ্টি। উপাদানে কমবেশি থাকতে পারে, কিন্তু পরমাণু পর্যায়ে নির্জীব এবং সজীব সব সৃষ্টি এক। মৌলিক কাঠামোগত দিক দিয়ে শত আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশে ভেসে বেড়ানো প্রস্তরখণ্ড আর পৃথিবীতে মালিকানার কামনায় বিভোর আমি বা আপনি একই জিনিস। বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক জ্ঞান অনুযায়ী ‘০ = ১’ হতে পারে না। সুতরাং সৃষ্টির শুরু শূন্য থেকে হতে পারে না। কিছু না কিছু এই বিশাল সৃষ্টির জন্য দায়ী। দায়ী কে তা পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা তালাশ করছেন কি না জানি না। তাবত পৃথিবীর বেশিরভাগ বিজ্ঞানী অনুসরণ করেন পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীসমাজ খুব শক্তভাবে কিছু অপরিবর্তনীয় পদার্থিক নিয়মে বিশ্বাস করেন। যেমন ‘০ = ১’ হতে পারে না, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, কক্ষপথ আবর্তন, সম্প্রসারণরত-ধাবমান মহাবিশ্ব এবং সমস্ত সৃষ্টির উৎস একই।

বিজ্ঞানের সূত্রমতে শুধুমাত্র ‘কিছু’ থেকেই কিছু সৃষ্টি হতে পারে, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। বলা যেতে পারে বিজ্ঞান এক্ষেত্রে এখনো জানে না বা সন্দিহান, দোদুল্যমান। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান একমত হতে বাধ্য যে সজীব একটি উৎস যদি তদ্রুপ না হয়, উৎসই যদি সৃষ্টির নিয়মে বাঁধা পড়ে যায় তাহলে সেটি সৃষ্টির উৎস বলেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এরকম আরো অনেক অপরিবর্তনশীল, স্থির নিয়মের সমুদ্রের মধ্যেই আমাদের জীবনযাপন। সমস্ত সৃষ্টির উৎস এক। সমস্ত সৃষ্টির এই উৎসটি মানুষের সংজ্ঞার মধ্যে সীমিত কোনো বিষয় নয়। এই উৎস অসীমিত, অভূতপূর্ব, অতুলনীয়, চূড়ান্ত, স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং স্বাধীন। সেই উৎসটি নিয়ম তৈরি করে সেই নিয়মের মধ্যেই সমস্ত মহাবিশ্বকে বেঁধে দিতে পারেন। কিন্তু নিজে সেই নিয়মের ঊর্ধ্বে থাকবেন। বিজ্ঞান বলবে, উৎসটি যে সজীব বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কিছু একটা হবে তার গ্যারান্টি কী? আবার বিজ্ঞান হলফ করে তাও বলতে পারবে না যে শূন্য থেকেই শুরু। কেননা বিজ্ঞানের সূত্রমতে শুধুমাত্র ‘কিছু’ থেকেই কিছু সৃষ্টি হতে পারে, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। বলা যেতে পারে বিজ্ঞান এক্ষেত্রে এখনো জানে না বা সন্দিহান, দোদুল্যমান। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান একমত হতে বাধ্য যে সজীব একটি উৎস যদি তদ্রুপ না হয়, উৎসই যদি সৃষ্টির নিয়মে বাঁধা পড়ে যায় তাহলে সেটি সৃষ্টির উৎস বলেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, সেই উৎসই চূড়ান্তভাবে, অর্থপূর্ণভাবে, স্বাধীনভাবে, সম্পূর্ণভাবে সবকিছুর মালিক। আমি বিশ্বাস করি, সেই উৎস একমাত্র আল্লাহ।

অতএব ভাই, আপনি যখন একটি গাড়ি, বাড়ি, জমি বা মোবাইল ফোন কিনবেন, যখন চুক্তিনামায় সই করবেন, যখন মালিকের ঘরে নিজের নাম লিখবেন, একটু চিন্তা করে দেখবেন। আর যদি মনে না থাকে তাহলে সকল চুক্তিনামার উপরে লিখে রাখেন “তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রমশালী, প্রবল, তিনিই অতিব মহিমান্বিত। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে পবিত্র, মহান।” (পবিত্র কোরআন, সুরা আল হাশর, আয়াহ ২৩)

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply