জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে আদর্শিক জীবনের কোনো বিকল্প নেই। বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ, সৃজনশীল কাজে অনন্য মানুষ, অপরিসীম সম্ভাবনাময় জীবন মানুষের। এ-কারণেই আদিমতা, বর্বরতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়েছে। চিন্তা, অনুসন্ধান, গবেষণার সাহায্যে আধূনিকতা ছাপিয়ে মানুষ এখন উত্তর আধুনিক যুগে বাস করছে।
একটি চমৎকার হেমন্তের সকাল। সোনা রোদ, পেয়ারা, বিলম্বি গাছের নীচে ও বাসার সীমানা দেয়াল জুড়ে সুন্দর একটি দোয়েলের বিচরণ, তার মিষ্টি কণ্ঠের সুরেলা ধ্বনি, অন্যপাশে পদশব্দ মানুষের, এক কথা একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ভাবছি জীবনের তাৎপর্য নিয়ে। বাসার সামনের রাস্তায় পথিক মানুষগুলো প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করে, কেউ কারো মুখপানে তাকায় না। যে যার কাজে, গন্তব্যে ছুটছে, নিত্য একই দৃশ্য। পথচলা, চলতে চলতে গন্তব্যে পৌঁছা, ছিটকে পড়া, হারিয়ে যাওয়া নিত্যকার ব্যাপার।
হঠাৎ মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে জীবন সংসার তাকে ত্যাগ করেছে। তিনি নেই, অর্থাৎ যাপিত জীবনের পরিসমাপ্তি। জীবনকে রূপময়, প্রাণবন্ত করতে মানুষের কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! অথচ একদিন তা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। তখন জীবন স্বপ্নহীন নিরর্থকতার রূপ নেয়। কোনো অর্থ বহন করে না, নীরব-নিথর লাশ।
এই যে মৃত্যু, যা নিয়ে ভাবতে গেলে স্থবির হয়ে যেতে হয়, নৈরাশ্য ভর করে। মৃত্যতে মানুষ মৃত্তিকায়, অগ্নিতে বিলীন হয়। তারপর শুধু বিশ্বাস। ধর্মানুষ্ঠান বা ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে স্বর্গ, অন্যথায় নরকবাস, যা সম্পূর্ণ অদৃশ্যনির্ভর। যার সঙ্গে যাপিত জীবনের কোনো মিল নেই। জীবনের দু:খ-কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা ও মৃত্যু অনুপস্থিত সেখানে। যাকে বলে, নিরবচ্ছিন্ন ও অনন্তকালের সুখ অথবা জ্বলতে থাকা। আর এখানে মানুষসহ সকল প্রাণীই দৃশ্যমান বাস্তবতার মুখোমুখি সারাক্ষণ। রোগ-ব্যাধি, জরা-খরা মোকাবেলা করে টিকে থাকা। প্রাণের পৃথিবীতে বিরাজ করে নিরন্তর যুদ্ধাবস্থা, দ্বন্দ্ব সংঘাত, বাদ প্রতিবাদ, অনিয়ম অনাসৃষ্টি। চলে বৈষম্য, বৈরিতা, আর ধনী-গরীবের অসম প্রতিযোগিতা।
এখানে শক্তের অপরাধের প্রতিকার পাওয়া কঠিন। যাঁরা এগুলোকে রুখতে ও প্রতিরোধ করতে ন্যায়ের দণ্ড নিয়ে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়ানোর কথা, তাঁরাই নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজেদেরকে সকাল-বিকাল দল পরিবর্তনকারীদের মত সাধারণ সারিতে নামিয়ে এনেছেন। এটা কি কোনো তাৎপর্য বহন করে? না, বরং জীবনকে চূড়ান্তরূপে অর্থহীন করে। এরূপ যাঁরা করেছেন তাঁদের কেউ কেউ অতীত গৌরবের অংশীদার, বরেণ্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষও আছেন। প্রশ্ন হলো- তাঁরা কী করে অতীত গৌরব, সাফল্যগাঁথা ও মর্যাদা ভূলুন্ঠিত করে আদর্শিক ও অর্থবহ জীবন পরিত্যাগ করলেন?
মৃত্যু, যা নিয়ে ভাবতে গেলে স্থবির হয়ে যেতে হয়, নৈরাশ্য ভর করে। মৃত্যতে মানুষ মৃত্তিকায়, অগ্নিতে বিলীন হয়। তারপর শুধু বিশ্বাস। ধর্মানুষ্ঠান বা ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে স্বর্গ, অন্যথায় নরকবাস, যা সম্পূর্ণ অদৃশ্যনির্ভর। যার সঙ্গে যাপিত জীবনের কোনো মিল নেই।
বিষয়টি অবাক করেছে। কারণ গতানুগতিক জীবনধারা অনুযায়ী সাধারণরা এ-রকম পরিবর্তনকে সহজ স্বাভাবিকভাবে নেয় না। যেমন আত্মহত্যার পর্যাপ্ত কারণ থাকলেও মানুষ আত্মহত্যাকে পছন্দ করে না, একে পাপ হিসেবে গণ্য করে। নীতি-আদর্শ ত্যাগ করাকেও আদর্শিক আত্মহত্যাই বলতে হয়। কেননা এতে আচরণ ও চর্চায় মানুষটির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। অতীতে যে ব্যক্তি মানুষকে পথ চিনিয়েছে, মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে যাঁর কথা গ্রহণ করে পথ চলেছে, নীতি, আদর্শ, স্বজাতি, স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তিনিই কিনা নিজের অবনমন ঘটিয়ে দিকভ্রষ্ট মানুষের কাতারে শামিল হয়ে মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছেন, আহ্বান জানাচ্ছেন মুক্তির।
শাখের করাতরূপী এই দ্বৈত ভূমিকা কারো কাম্য হতে পারে না। মানুষ তো দাবার ঘুটি নয়, রক্ত-মাংসে গঠিত চেতনা ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ। কাল কিংবা ইতিহাসও তাই বলে। জীবনকে অর্থপূর্ণ মনে না করেও বলা যায়- নীতি, আদর্শধারী মানুষগুলো, যাঁরা দীর্ঘ চর্চার দ্বারা মানুষ, সমাজ, পরিবেশের উন্নয়নে দু:খ-কষ্ট ও নির্যাতন সয়েও অবদান রাখতে সক্ষম হয় তাঁদেরকেই সাধারণরা সত্যিকার বন্ধু ও মানুষরূপে হৃদয়ে স্থান দিয়ে থাকে।
পরকালীন জীবনে স্বর্গপ্রাপ্তি ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব প্রার্থনা বা উপাসনার ফলস্বরূপ, যা বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু নৈতিকতা ও আদর্শ রক্ষাপূর্বক মানুষ যে ভূমিকা বা দায়িত্ব পালন করে তা সামগ্রিকভাবে প্রতিফলিত হয়। জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে তার সুফলভোগী হয় সবাই। ইতিহাস, কাল তাঁদেরকেই মর্যাদা দেয়, তাঁদের জীবনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়। আর যারা কিঞ্চিত লাভ, লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করে, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, স্বজনতোষণে লিপ্ত থাকে তারাই কালের, ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। সুতরাং নীতি নৈতিকতা ও আদর্শবর্জিত ডিগবাজির জীবন অমর্যাদাকর, অপমানের, অপূর্ণতার। জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে তাই আদর্শিক জীবনের কোনো বিকল্পপ নেই।
যারা আত্মসমীক্ষণ, আত্মসংশোধনের ধার ধারে না, সামান্য লোভের, মোহের নিকট নিজেকে সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় সমর্পন করে, আদর্শ জীবন পরিত্যাগ করে তারা নিজেকেও কলুষিত করে, সমাজ-পরিবেশকেও দূষিত করে। এদের জীবনই বৃথা, অসার, অমর্যাদাকর।
জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে আদর্শিক জীবনের কোনো বিকল্প নেই। বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ, সৃজনশীল কাজে অনন্য মানুষ, অপরিসীম সম্ভাবনাময় জীবন মানুষের। এ-কারণেই আদিমতা, বর্বরতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়েছে। চিন্তা, অনুসন্ধান, গবেষণার সাহায্যে আধূনিকতা ছাপিয়ে মানুষ এখন উত্তর আধুনিক যুগে বাস করছে। চক্ষুষ্মান, চিন্তাশীল মানুষ ঠিকই জানে বর্তমান সমৃদ্ধিতে পৌঁছতে মানুষকে সহস্র সহস্র কিলোমিটার দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সীমাহীন দুর্ভোগ, কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অথচ তা সত্বেও মানবজীবনে পুরোপুরি স্বস্তি, শান্তি আসেনি।
বলা হয়- ‘মানুষ জন্মায় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত’। এই শৃঙ্খলার বিষয়টিই প্রধান। মানুষ যখন জন্মায় তখন সে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য’র মত বদগুণসমূহ তার রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জার সঙ্গে বহন করে নিয়ে আসে। অর্থাৎ আকরিক বা কাঁচা লোহার মত এবরোখেবরো থাকে সে। এর সাথে যুদ্ধ করেই মানুষকে এগুতে হয়। যে ব্যক্তি তার ভেতরের এই বদগুণগুলোকে পরাস্ত করে যতবেশী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, সে ততটাই শুদ্ধতা অর্জন করে, সভ্য মানুষের পরিচিতি পায়। যে সমাজে এমন শুদ্ধ ও সভ্য মানুষের সংখ্যা যতবেশী সেই সমাজ ততটাই সভ্য বলে পরিগণিত হয়।
পাশাপাশি এই মানুষগুলো ধৈর্য্য, সংযম, সহিষ্ণুতা, সত্য ও ন্যায়ের চর্চাও চালিয়ে যায় অবিরাম। অন্যায় অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিরোধী হয়। আবার আত্মসমীক্ষণপূর্বক সংশোধন প্রক্রিয়ার দ্বারা তাঁরা নিজেকে আমৃত্যু সদ্গুণের মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত রাখতে সমর্থ হয়। এভাবেই তাঁদের জীবন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানবজাতি তাঁদেরকেই বরণ করে, স্মরণ করে। তবে যারা আত্মসমীক্ষণ, আত্মসংশোধনের ধার ধারে না, সামান্য লোভের, মোহের নিকট নিজেকে সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় সমর্পন করে, আদর্শ জীবন পরিত্যাগ করে তারা নিজেকেও কলুষিত করে, সমাজ-পরিবেশকেও দূষিত করে। এদের জীবনই বৃথা, অসার, অমর্যাদাকর।
লেখকের সব লেখা
মোজাম্মেল হক: চিন্ত্যক, কলামিস্ট
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]