বরাবরের মতো এবারও নতুন পুলিশ সুপার কিছু ‘গণ্য’ ও ‘মান্য’ সাংবাদিকদের নিয়েই তার “সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা” সম্পন্ন করেন। মতবিনিময়কালে অতীত পুলিশ সুপারদের মতোই তিনি জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ‘গণ্যমান্যদের’ সহযোগিতা কামনা করেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাঁশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলেও বাঁশের বহুমুখী ব্যবহারে সারাবিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম। এক্ষেত্রে অনেক বছর ধরেই ‘উন্নয়নশীল’ এ দেশটি গর্বের সঙ্গে তার শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। অন্যদিকে এতদিন বিশ্বের মানুষ জানতো তেলের সব খনি কেবল আরব বিশ্বেই। কিন্তু এবার মানুষের ধারণা পাল্টেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে তেলের বিশাল বিশাল খনি। যদি এ তেল বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা যায়, তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশই হবে বিশ্বের সুপার পাওয়ার। কারণ এ তেল উৎপাদনে তেমন কোনো খরচাপাতি নেই। কেবল মুখে কিছু ভাষা আর মনটা ‘ফ্রেশ’ হলেই চলে।
এ তেল ছাড়া এখন বাংলাদেশে পুলিশ, প্রশাসন, সরকার, বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ- সব অচল। কার আগে কে দিতে পারে, কতবেশি দিতে পারে তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার বিষয়। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের নামে, সংবর্ধনার নামে, ‘সৌজন্য সাক্ষাতের’ মাধ্যমে চলে এ তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার। বিশেষ করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি এমপি, মন্ত্রীদের নিজ জেলায় আগমন, শুভাগমন, অনুগমনে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতাদের থাকে শুভেচ্ছা লাইন। অন্যদিকে ডিসি, এসপি, এএসপি, টিএনও-রা ইদানিং ঘন ঘন বদলি হচ্ছে জেলা উপজেলায়। এদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। এসবের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা, পাতিনেতা, তথাকথিত সাংবাদিক, সাংবাদিক সংগঠন, মানবাধিকার কর্মীরা শুভেচ্ছা, অভিনন্দন কিংবা সৌজন্য সাক্ষাত করতে লাইন ধরে।
আবার যারা আরেকটু প্রভাবশালী, দীর্ঘদিন ধরে কোনো একটা সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছে, যেমন জেলা প্রেসক্লাব, পুরনো বা প্রভাবশালী সাংবাদিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন- এদের সঙ্গে স্বয়ং সেসব কর্মচারীরা দেখা করেন, অথবা ‘মতবিনিময় সভা’ বা ‘প্রেস কনফারেন্সের’ নামে তাদের ডাকা হয়। আর এ সব প্রক্রিয়াই একে একে সম্পন্ন করেছেন সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবাগত পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান।
তিনি গত ২৭ জুলাই যোগদানের পর থেকে এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ডিসি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনে তিনি সিক্ত। একটু পরিবর্তন করে কেউ কেউ জানাচ্ছেন উষ্ঞ অভ্যর্থনা! আর ফেসবুকে চলছে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের বন্যা। সবার একটাই আশা, যে কোনোভাবে ‘এসপি সাবের’ নজরে আসা। যদিও যে কোনো মুহূর্তে তিনিও বদলি হতে পারেন।
অবশ্য এ ধারা আজ নতুন নয়, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই চলমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এটা আরো বেশি। সমাজগবেষকরা জানান, এতে করে নতুন যোগদান করা কর্মকর্তা নিজেই অনেকের কাছে ফেঁসে যান, আবার তিনিও অনেককে ফাঁসান। কিন্তু সবশেষে এসবের ফলাফল একটাই, উভয়পক্ষই ব্যক্তিস্বার্থে এসব পদ-পদবী ব্যবহার করেন, প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও হিসাব-নিকাশ করেন। প্রকৃত কাজ কখনো এসবের ভেতর দিয়ে হয় না, হওয়া সম্ভব নয়। আর সত্যিকার মানুষগুলো তাদের কাছে পৌঁছুতে পারে না, তারাও সত্যিকার মানুষদের কাছে পৌঁছাতে পারেন না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও নতুন পুলিশ সুপার কিছু ‘গণ্য’ ও ‘মান্য’ সাংবাদিকদের নিয়েই তার “সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা” সম্পন্ন করেন। মতবিনিময়কালে অতীত পুলিশ সুপারদের মতোই তিনি জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ‘গণ্যমান্যদের’ সহযোগিতা কামনা করেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আবার সেই আগের মতোই এসব ‘মতবিনিময় সভা’ নিউজ আকারে কপিপেস্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে ও ফেসবুকে। আবারও চলে ফেসবুকে অভিনন্দন-বন্যা।
ক্যাটাগরি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শীর্ষ তিন
[sharethis-inline-buttons]