শুক্রবার বিকাল ৩:৩০, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

সাংবাদিকতার ল্যাঠা : ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ’ নিউজ

জুনায়েদ আব্দুল্লাহ গালিব

যুবতী মেয়েদের ছবি সংবলিত যে কোনো রিপোর্ট বাজারে বেশি কাটতি পায়। ইন্টারনেট থেকে সাদা চামড়ার অর্ধনগ্ন তরুণীদের ছবি নিয়েও তো রিপোর্ট করতে পারেন। হোক না রিপোর্টের শিরোনাম ‘সবুজ চা পানের উপকার’। সেখানে সবুজ চায়ের কাপ হাতে সাদা চামড়ার অর্ধনগ্ন তরুণীর ছবি থাকলে তবেই না মানুষ ওটা পড়বে। ওগুলো ইন্টারনেট থেকে কপি করা ফ্রি ছবি, সূত্র-মূত্র উল্লেখ করা লাগে না।

আমার পরিচিত একজন সাংবাদিক আছেন। শুরুতে সাংবাদিকতার ইচ্ছা না থাকলেও সমাজভাবনা ও লেখালেখির এক পর্যায়ে তিনি ভাবলেন লেখক-সাংবাদিক হিসেবে কিছুটা ভূমিকা রাখবেন। বক্ষমান লেখায় আমরা তার ছদ্মনাম দিতে পারি শীতল আকাশ। শীতল আকাশ নামকরণের মাজেজাটা আরেকদিন বলব। তো শীতল আকাশ ভাই বড় নাছোড়বান্দা মানুষ। ঈদের আনন্দ তার গায়ে ধরে না। যেমন বৃষ্টির পানি কলাপাতায় লাগে না। পুরো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যেখানে ঈদের আনন্দে গদগদ, যুবতী রমণীরা কে কোথায় কী কিনছেন তা ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজ্ঞাপনের স্লট বেঁচে তা অতিগুরুত্বপূর্ণ ‘নিউজ’ হিসেবে প্রচার করে, ঈদের সাতষট্টিতম দিনের অনুষ্ঠানসূচি ইত্যাদি প্রচারে ব্যস্ত, এতকিছুর মাঝে শীতল ভাই জ্ঞানগর্ভ গদ্যমালা নিয়ে হাজির হন। উঠতি সাংবাদিকরা যেখানে ঈদের বাজারে রাজনীতিবিদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, প্রযোজক, প্রোডাকশন হাউস ইত্যাদি উৎস থেকে ঈদের ‘সালামি’ নিয়ে হাসিমুখে গিন্নির জন্য পছন্দের জামা, ছেলে-মেয়ের জন্য পছন্দের উপহার জোগাড়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন তিনি কি না তাতে ঠাণ্ডা পানি ঢালেন। তিনি কোন কিসিমের ‘সাংবাদিক’ তা আমার মাথায় খাটে না।

তার লেখা ও রিপোর্টিংয়ে না আছে উত্তেজনা, না আছে ‘আধুনিকতা’। ক্যামেরা ঘাড়ে ঝুলিয়ে, পথে-প্রান্তরে, ইস্কুল-কলেজে, জানাজা-মিলাদে, সভা-সেমিনারে গিয়ে যুবতী রমণীদের ছবি তুলে রিপোর্টিংয়ের কাভারে না দিলে কি আর কেউ তার রিপোর্ট পড়বে? তিনি কি জানেন যে রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী যুবতী মেয়েদের ছবি সংবলিত যে কোনো রিপোর্ট বাজারে বেশি কাটতি পায়? ইন্টারনেট থেকে সাদা চামড়ার অর্ধনগ্ন তরুণীদের ছবি নিয়েও তো রিপোর্ট করতে পারেন। হোক না রিপোর্টের শিরোনাম ‘সবুজ চা পানের উপকার’। সেখানে সবুজ চায়ের কাপ হাতে সাদা চামড়ার অর্ধনগ্ন তরুণীর ছবি থাকলে তবেই না মানুষ ওটা পড়বে। ওগুলো ইন্টারনেট থেকে কপি করা ফ্রি ছবি, সূত্র-মূত্র উল্লেখ করা লাগে না। আবার নেট থেকে পরচর্চারীতির যত খবর বের হয় যেমন বলিউডের কোন নায়িকা কাকে কখন চুমু খেল, হলিউডের কোন নায়িকার নগ্ন হতে আপত্তি নেই ধরনের খবর সূত্রমূত্র ছাড়া হুবহু কপি অনুবাদ মারলেই হয়। তাতেও কি পরিমাণ কাটতি শীতল ভাই কি জানেন? পাঠকের নজর না কাড়তে পারলে সেটা কোনো রিপোর্টিংই হবে না। তিনি কি জানেন যে স্কুল-কলেজে মেয়েদের গ্রুপ ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিক/ক্যামেরাম্যানরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ‘সুন্দরী’ মেয়েদের সামনে দাঁড়াতে বলেন আর বাকিদের পেছনে পাঠিয়ে দেন?

শীতল আকাশ ভাই বড় নাছোড়বান্দা মানুষ। ঈদের আনন্দ তার গায়ে ধরে না। যেমন বৃষ্টির পানি কলাপাতায় লাগে না। পুরো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যেখানে ঈদের আনন্দে গদগদ, যুবতী রমণীরা কে কোথায় কী কিনছেন তা ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজ্ঞাপনের স্লট বেঁচে তা অতিগুরুত্বপূর্ণ ‘নিউজ’ হিসেবে প্রচার করে, ঈদের সাতষট্টিতম দিনের অনুষ্ঠানসূচি ইত্যাদি প্রচারে ব্যস্ত, এতকিছুর মাঝে শীতল ভাই জ্ঞানগর্ভ গদ্যমালা নিয়ে হাজির হন।

একটি ক্যামেরা, একটি মাইক, কাগজ-কলমের যে পাওয়ার তা তাকে কে বোঝাবে! এই ক্যামেরার সামনে মানুষ গু খেলেও তা গুরুত্ব সহকারে সাংবাদিকরা প্রচার করতে পারেন। একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ যতই বলুক ‘আমরা সবাই ভাই ভাই’, আর মন্ত্রী-মিনিস্টাররাও একই কথা বলুক, একমাত্র সাংবাদিকরাই পারেন সুবিধামতো বিচার করতে কার কথাটি তারা তুঙ্গে উঠাবেন। এমন কথাকে সাংবাদিকরা নোবেল পুরস্কারের যোগ্য হিসেবেও প্রচার করতে পারেন। এখানে কথা গুরুত্বপূর্ণ না, সাংবাদিকদের পাওয়ারই বড় ব্যাপার। যে যতই জ্ঞানগর্ভ, মানবিকতার কথা বলুক আর যে যতই সাধারণ কথা বলুক সাংবাদিকদের পাওয়ারের ব্যাকিং না থাকলে সব মাঠে মারা যাবে। আছে শীতল আকাশ ভাইয়ের এমন পাওয়ার? না থাকলে উনি কিসের সাংবাদিকতা করেন? চটকদার, ঝলমলে রঙিন ট্রিক্স না খেললে কে শুনবে তার কথা?

এখন ‘বাঙালি’ জাতিসত্তার সিজন। তাকে কখনো দেখিনি বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কোনো লেখা লেখতে। তার যত ঘেনর ঘেনর সব সামগ্রিক মানব সমাজ নিয়ে। তার কাছে নাকি সব মানুষ সমান। কি বিপদজনক কথা? কেন বাপু, আমাদের দেশের মানুষ কি দোষ করেছে? কোমলমতি শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কড়া রোদে দাঁড়িয়ে দেশাত্মবোধক গান- ‘তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা’ ইত্যাদি নিয়ে কখনো কোনো ধনাত্মক রিপোর্টিং তাকে করতে দেখিনি। থাকুক পৃথিবীর সব দেশে এরকম গানের লিস্ট, থাকুক সব দেশের ‘দেশপ্রেম’ গজানোর নিজস্ব পদ্ধতি। গ্রাম-গঞ্জে ওসি সাহেব থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বড় মাপের মানুষেরা দর্শন-পরিদর্শনে গিয়ে থাকেন। তাদের প্রীত করতে পারলে কিছু অনুদান, কিছু সুনজর, কিছুটা ব্যক্তি-সুবিধা পাওয়া যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা আগ্রহসহকারে, আবহাওয়ার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, একমাত্র দেশের টানে, সরকার- প্রশাসনের প্রতি আনুগত্যের টানে লাইনে দাঁড়িয়ে ফুল ছেটায়। আহা! এই না হলে দেশপ্রেম! এই না হলে ঔপনিবেশিকদের রেখে যাওয়া দেশপ্রেমের ফর্মুলা! শীতল ভাইকে কখনো দেখি না এসব দেশপ্রেমের ‘উৎকৃষ্ট উদাহরণ’ কাভার করতে।

আমাদের হালের ‘গৌরব’ ক্রিকেট নিয়েও দেখি না তার কোনো মাথাব্যথা। সমগ্র জাতি যেখানে কয়েক সপ্তাহ উৎসবে মাতে, নিজেদের দাসসুলভ অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়ে সাময়িক উদ্যমে গা ঘামায়, কোথায় এক্ষেত্রে আমাদের শীতল ভাইয়ের সাংবাদিকীয় ভূমিকা? বিশ্বব্যাপী ক্রমবিলুপ্ত খেলা ক্রিকেটের ব্যাট পিটিয়ে বিশ্ব ‘জয়’ করার স্বপ্ন দোষের কিছু না। ঔপনিবেশিকদের শিখিয়ে দেয়া খেলা আমরা তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করি, আহা কি শান্তি! বিজয়ের আনন্দে দেশের সব অবিচার-ব্যভিচার কয়েকদিনের জন্য শৃঙ্খলবন্দী হয়ে থাকে। এ জাতীয় খবর কখনো আকাশ ভাইয়ের রিপোর্টে থাকে না।

এখন ‘বাঙালি’ জাতিসত্তার সিজন। তাকে কখনো দেখিনি বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কোনো লেখা লেখতে। তার যত ঘেনর ঘেনর সব সামগ্রিক মানব সমাজ নিয়ে। তার কাছে নাকি সব মানুষ সমান। কি বিপদজনক কথা? কেন বাপু, আমাদের দেশের মানুষ কি দোষ করেছে? কোমলমতি শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কড়া রোদে দাঁড়িয়ে দেশাত্মবোধক গান- ‘তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা’ ইত্যাদি নিয়ে কখনো কোনো ধনাত্মক রিপোর্টিং তাকে করতে দেখিনি।

বিশ্বব্যাপী এখন গণতন্ত্রের জন্য মানুষের হাহাকার। সিরিয়ার ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করা পাঁচ বছরের একটি শিশুর ক্রন্দনরত চোখজোড়ায় এ গণতন্ত্রের কামনা। এ ব্যাপারেও শীতল আকাশ ভাই বড় সেকেলে। যুগ যুগ ধরে বিরাজমান আন্তর্জাতিক যুদ্ধের মাঝেও বিশ্ববিবেক সেই ছবিটি দেখে প্রায় পাঁচ-সাতদিন কেঁদেছিল। পণ করেছিল হানাহানি মারামারি বন্ধ করবে, আলোচনায় বসবে। এই আশার প্রদীপের মাঝেও শীতল ভাই অনুপস্থিত। উনি কি জানেন না যে গণতন্ত্র এলে মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করবে, যার যা খুশি তাই করতে পারবে, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও যা খুশি তাই করতে পারবে? যেমন ৩১টি বা তারও বেশি আইসক্রিমের ফ্লেভার থেকে বেছে নেয়া, সন্তান জন্মদানে পিতৃপরিচয়ের শৃঙ্খল না থাকা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চর্চা, উলঙ্গ হয়ে সম্মানহানি এবং রাস্তায় যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করা ইত্যাদি?

স্বাধীনতার কথাও তার লেখায় আসে না। ইংরেজ ও পাকিস্তানি আমলে যেভাবে একতরফা চুক্তি হতো, বিশেষ শ্রেণীর জন্য বিশেষ সরকারি সুবিধার ব্যবস্থা করা হতো সেসব এখন কিছুই নাই। প্রজাতন্ত্র বলেই বাংলাদেশের মানুষ এখন আর ‘প্রজা’ নেই যে তারা কোনো রাজার পূজা করবে। পরাধীন আমলে সরকারি আমলা-অফিসারদের যেভাবে স্যার স্যার বলে পদলেহন করা হতো, এখন উল্টো সরকারি আমলা-অফিসাররা সাধারণ জনগণকে স্যার স্যার বলে হাসিমুখে ‘সেবা’ দিয়ে থাকেন।

এ দেশের মানুষ এখন চাইলেই ‘নিজেদের’ টাকায় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, মহাসড়ক বানাতে পারে; উন্নয়নের খরচ-হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিতে পারে। এখন আমাদের দেশের মানুষ চাইলেই তার জন্মগত মেধা, শিক্ষা তালাশ করে আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। জি.পি.এ পাঁচ পেয়ে ইঁদুরের মতো না দৌড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এম.বি.এ পাশ করে খুব সহজেই আঠারো-বিশ হাজারের মাইনে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ আরামসে জীবন শুরু করতে পারে। একবার ভেবে দেখুন পুরোনো আমলে কোথায় ছিলো এই জন্মগত স্বাধীনতা। আমরা এখন নিজেদের জন্ম-মৃত্যুর ‘স্বাধীনতাও’ উপভোগ করছি। কিন্তু শীতল আকাশ ভাইয়ের মতো সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে ‘রা’ করেন না। তাই বলেছিলাম, শীতল আকাশ বড় অবুঝ মানুষ। তাদের মতো লোকেরা সাংবাদিকতা করলে একদিন সাংবাদিকতার ল্যাঠাই চুকে যাবে!

জুনায়েদ আব্দুল্লাহ গালিব : প্রবাসী, যুক্তরাষ্ট্র

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply