ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সবচেয়ে বড় কবরস্থান শিমরাইলকান্দি গ্রামে। বাংলাদেশের অন্য অনেক জায়গার মতো এখানেও শ্মশান-গোরস্থান পাশাপাশি অবস্থিত, যা ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্পীতির অনন্য নজির। তবে এ লেখায় শ্মশান-গোরস্থানকে কেন্দ্র করে একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাই। একটা সময় ছিল, যখন শ্মশান-গোরস্থানের নাম শুনলেই গা শিউরে উঠত। দলে দলে ভূত-প্রেতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠত। ভূত-প্রেতের কথা বলে পিতা-মাতাগণ সন্তানদের ভয় দেখাতেন। এ নিয়ে মুরব্বিদের স্মৃতিচারণ মুখে মুখে ফেরে। আমার ছোটবেলায় সে জায়গাটি কেমন ছিল?
আশির দশকের কথা। শিমরাইলকান্দি কবরস্থান। নীরব-নিস্তব্ধ, গা ছমছম করা নিঝুম জায়গাটা ক্লান্তিহীন দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো প্রাচীন বট গাছ। শ্মশানে বসবাসহীন পুরনো ভূতুড়ে কিছু বিল্ডিং। দিনের বেলায় বট গাছের নিচের বিল্ডিংয়ে ঝুলে থাকত অনেক বাঁদুর। কবরস্থানের বিভিন্ন জায়গায় অদ্ভুত কিছু গাছ। কিছু দূরে দূরে ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল-অন্ধকার। এর বুক চিরে বয়ে গেছে মূল পথ। অর্থাৎ পথের পূর্ব-পশ্চিম দুদিকেই বিশাল কবরস্থান। পূর্ব দিকটায় বহমান অদ্বৈত মল্লবর্মন আর আল-মাহমুদের সেই বিখ্যাত তিতাস নদী। মূলত এটিই শহরের ভেতরে একটি অনন্য গ্রাম। তিতাস নদী, বিশাল বিল, শ্মশান-গোরস্থান, রেললাইন, গ্যাসফিল্ড ইত্যাদি শিমরাইলকান্দিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। করেছে সৌন্দর্যে-সম্পদে সমৃদ্ধ। নদীর পর মাইল কি মাইল বিল ও ধানী জমি। শব্দহীন নির্জন জায়গাটায় সন্ধ্যার পরপরই শিয়ালের ডাক শোনা যেত। সবমিলিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন গা ছমছম করা নিরব-নিস্তব্ধ ভূতুড়ে পরিবেশ।
এলাকার সবাই বলাবলি করত শ্মশানের বটগাছে মধ্যরাতে ভূতের দেখা মিলে। কেউ কেউ ভূত-প্রেতের সাক্ষাৎ পাওয়ার দাবিও করত। জায়গাটি যে প্রচণ্ড ভয়ঙ্কর তা ছোট বড় সবারই জানা। বিশেষ করে ঠিক দুপুর এবং সন্ধ্যারাতে। মধ্যরাতে তো কেউ স্বপ্নেও সেখানে যাওয়ার সাহস করত না। ভূত-প্রেতের ভয় তো আছেই, তাছাড়া কোনো মৃত ব্যক্তি সহসা কবর থেকে উঠে ধরে ফেলে কিনা! কয়েকদিন আগে এক ‘ঠিক দুপুরে’ পেত্নী ধরে নিয়ে যায় গোবর কুড়াতে যাওয়া মেয়েটিকে। এর কয়দিন যেতে না যেতেই সন্ধ্যায় গরু আনতে গিয়ে পাগলা দাদার বউ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে শোনা যায়, তিনি নাকি হঠাৎ সাদা কাপড় পড়া এক মহিলাকে কুপি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমার অবশ্য ভূত-প্রেতে বিশ্বাস ছিল না শিশুকাল থেকেই। তারপরও তের বছর বয়সের সেই কিশোরকালে ভূত দেখার এক অদম্য কৌতুহল মনে জেগে উঠে।
অনেকবার, অনেক সন্ধ্যায় চেষ্টা করেও সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। অজানা এক ধরনের ভয় ও শঙ্কা মনে কাজ করত। গল্প-কাহিনীতে শুনতাম ভূত-প্রেতরা নাকি লোহা ও আগুনের সামনে আসে না। একদিন এশার পর একা একা কবরস্থান-শশ্মানের মাটির রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটা ধরলাম। অন্ধকার রাত! কিছুদূর যেতেই হঠাৎ শরীর মোচড় দিয়ে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে নামলো ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত। গায়ে কাঁটা দিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে ভেতরটা, এক অজানা ভয়ে। ক্ষণিকের তরে ভেঙ্গে গিয়েছিল অবিশ্বাসের বাঁধ।
একজন আগন্তুকের হঠাৎ আগমনে কিছুটা সস্তি পাই। কাছে আসতেই দেখলাম তিনি আমার এলাকার মুখপরিচিত। আমি তার পিছু নিলাম। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থান এবং শ্মশানের ভয়ঙ্কর ভূত-প্রেতের বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মিনিট খানেক ঘাড় ঘুড়িয়ে ভূত-প্রেত খুঁজতে শুরু করলাম। এর মধ্যেই পরিচিত লোকটা অনেক সামনে চলে গিয়েছেন। আর কোনো দিকে না তাকিয়েই এক দৌড়ে তার কাছাকাছি চলে গেলাম এবং বললাম, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি একদৌড়ে ওপারে চলে যায়।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন। এভাবে শুরু করলাম ভূত-প্রেত খোঁজার মিশন। যেন এই লক্ষ্যটা একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় ভয় কেটে গেল। যেখানেই বেড়াতে গিয়েছি, ভূত-প্রেত খুঁজেছি। রাত বিরাতে শ্যাওড়া গাছে কিংবা বাঁশঝাড়ের ঘন আড়ালে। যেখানেই শুনতাম ভূত-প্রেতের কথা, সেখানেই দিতাম ছুট। যত বিদ্ঘুটে ভয়ংকর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতই হোক না কেন, একা একা হেঁটেছি, কখনো ফজরের আজানের আগে, কখনো বা অমাবস্যার নিশি রাতে। রেললাইন ধরে কুরুলিয়া রেল ব্রিজের নিচে-উপরে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করেছি বছরের পর বছর। শ্মশান আর মঠে (হিন্দুদের বিশাল মঠ, এখন যেখানে গাঁও-গেরাম রেস্তোরা) যে কতবার গিয়েছি তার কোন গণনা নেই।
একদিন গভীর রাতে, শিমরাইলকান্দি বড়বাড়ির পুকুর পাড়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি পিত্তশুল গাছের নীচের ঝোপটায় কী যেন নড়ে উঠল। আমি থমকে গেলাম। মুহূর্তেই দেখি আড়ালের ভেতর থেকে কী যেন দৌড়ে পালাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতেই বুঝলাম, একটা সাদা প্রাণী, বিড়াল জাতীয় কিছু। নাহ, সাইজে বিড়ালের চেয়েও বড়। লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমিও পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে কবরস্থানের একটি গর্তের ভেতর থেকে ধরে ফেললাম। তখন থেকেই দৃঢ়বিশ্বাস, পৃথিবী নামক গ্রহে ভূত-প্রেতের অস্তিত্ব কখনো ছিল না। বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষই ভূতে বিশ্বাস করে। সারাবিশ্বে আলোচিত-সমালোচিত ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প-কাহিনী-ঘটনাও বিস্তর। এসবই গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই না। গর্তের প্রাণীটা সাদা বড় ছাগল বা পা-ওয়ালা গর্ভবতী খরগোশ ছিল। কিছু দিন পরই দুটো বাচ্চাও প্রসব করে।
এ লেখার মূল উদ্দেশ্য, পিতামাতাগণ যেন বাচ্চাদের অবাস্তব ভূত-প্রেতের গাঁজাখুরি গল্প বলা বন্ধ করেন। তাদের মাথায় এসব ভয় ঢোকানো মারাত্মক অন্যায়। যদি কেউ ভয় পেয়ে যায় তাকে সে স্থানে নিয়ে যান। তাকে ঘুরে ঘুরে দেখান সে জায়গাটা এবং বোঝান যে এসব ভূতটুত বলে কিছু নেই। অবশ্য ভূতের চেয়েও ভয়ংকর যে প্রাণী তার নাম মানুষ। উল্লেখ্য, একজন হুজুর বলেছেন ভূত-প্রেত হচ্ছে আসলে দুষ্টু জ্বীন। দুষ্টু জ্বীনের পুরুষকে বলা হয় ভূত, আর নারীকে প্রেত। সুন্দরী নারী জ্বীনদের অনেকে বলেন পরী। সুতরাং ভূত-প্রেত অস্বীকার করলেও জ্বীনদের অস্বীকারের সুযোগ নেই। ধর্মেও এর অস্তিত্ব আছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে।
জাহাঙ্গীর আলম বিপ্লব : সমাজকর্মী ও সাংবাদিক
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]