উপর মহলকে সন্তুষ্ট করে অযোগ্য ব্যক্তি যোগ্য পদে বসতে পারে, পদোন্নতিও পেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে একটি প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়, ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট।’ চাকরির শুরুতে এ প্রবাদের উদাহরণ দিয়ে শেখানো হয়, বস যখন যা বলবে তাই মানতে হবে। অর্থাৎ অন্যায়-দুর্নীতি ও চুরি-চামারি করতে বললেও তাই করতে হবে।
পেশা হচ্ছে জীবন ধারণের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকুরি বা অন্য কোনো বৃত্তি বিশেষ। পেশার মাধ্যমে ব্যক্তি অর্থ উপার্জন করে বা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বাংলাদেশে পেশা হিসেবে চাকরির চাহিদা খুব বেশি। বেসরকারি চাকরি থেকে সরকারি চাকরির চাহিদা অনেক বেশি। যে কারণে সরকারি চাকরি বর্তমান বাজারে সোনার হরিণ।
চাহিদার তুলনায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কম থাকায় সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে চাকরি-প্রত্যাশীদের বিশাল দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা যায়। একে কেন্দ্র করে শুরু হয় চাকরি-বাণিজ্য। এক্ষেত্রে যারা ক্ষমতা ও লেনদেনে এগিয়ে থাকে, সোনার হরিণ তাদের ভাগ্যেই জুটে। যাদের ক্ষমতার দাপট নেই অথচ দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন সন্তান, তাদের সরকারি চাকরির প্রত্যাশা করা কল্পনামাত্র।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে চতুর্থশ্রেণির একটি পদের জন্য লাখ টাকার ঘুষ-বাণিজ্য হয়ে থাকে। শুধুমাত্র মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে জনবল নিয়োগ হয়ে থাকে এমন নিয়োগের সংখ্যা খুবই কম। ঘুষ বা অসৎ পন্থায় যারা সরকারি চাকরি লাভ করে থাকে অথবা যারা নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকা কিংবা শেষ সম্বলটুকু বেঁচে দিয়ে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে, তাদের কাছ থেকে কতটুকু সেবামূলক কাজ সৎ ও আদর্শের মাধ্যমে আশা করা যায়? যে পেশার নিয়োগই লাভ করা হয় দুর্নীতির মাধ্যমে? এমন চাকরিজীবীদের মাধ্যমে কেবল দুর্নীতিই বিস্তার লাভ করা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৪১ টি মন্ত্রণালয় আছে। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে অধিদপ্তর, অধীনস্থ দপ্তর এবং কতিপয় আধা-সরকারি সংস্থা। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ লক্ষ ৮২ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। সরকারি বিভিন্ন কার্য সম্পাদন এবং নাগরিকদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চলে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম। এক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ঘুষ বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি। ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি বা শেষ সম্বলের খরচ পূরণ করতে গিয়ে চলে অসৎ কার্যক্রম। আবার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপের কারণেও অনেক নীতিহীন কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও আধা-সরকারি সংস্থায় দুর্নীতির জাল ছড়িয়ে আছে।
এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা সৎ থাকতে চাইলেও তার উপরস্থ অধিদপ্তর বা দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাপে তিনি দুর্নীতিবাজি করতে বাধ্য হন। ফলে অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ সৎভাবে কাজ করতে চাইলেও সম্ভব হয় না। আবার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দায়িত্ব এমন অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে দেয়া হয়, যিনি তার অধিদপ্তর বা উপর মহলের কাছে সবসময় অনুগত থাকেন ও চুপিসারে খুশি রাখেন। দেশের সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং মানুষের কতটুকু সেবা অর্জিত হলো- সেটা আর বিবেচ্য বিষয় থাকে না। লুটেপুটে স্বার্থ আদায় করাটাই হয়ে উঠে মুখ্য বিষয়।
উপর মহলকে সন্তুষ্ট করে অযোগ্য ব্যক্তি যোগ্য পদে বসতে পারে, পদোন্নতিও পেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে একটি প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়, ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট।’ চাকরির শুরুতে এ প্রবাদের উদাহরণ দিয়ে শেখানো হয়, বস যখন যা বলবে তাই মানতে হবে। অর্থাৎ অন্যায়-দুর্নীতি ও চুরি-চামারি করতে বললেও তাই করতে হবে। এ শিক্ষা-প্রশিক্ষণের অবস্থান যেমন দেশ ও জনগণের বিপক্ষে, তেমনি আদর্শ ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির বিস্তারে এসব বিষয়ও ভূমিকা রাখে। অসৎ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ভিড়ে সৎ ও আদর্শবানরা কোণঠাসা হয়ে থাকেন এবং তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সরকারি বিভিন্ন টেন্ডার-প্রক্রিয়া, বদলী-বাণিজ্য, পেনশন-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলেঅতে রাজনৈতিক ও পারিবারিক হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে। সরকারি বড় পদে থাকলে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে তাদের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। একটি সাক্ষরের জন্য তাদের কাছে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। তাদের দেখা পাওয়াটা অনেক সময় পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। ‘বড়কর্তার’ একটি সাক্ষরের কারণে কত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, পেনশন, বদলীসহ কতরকম সুযোগ-সুবিধা, পাওনা আটকে থাকে সে খবর অজানাই থেকে যায়।
দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয় যদি দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হয়, তবে সারা দেশের সব সরকারি অধিদপ্তর, দপ্তর, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। দেশের উন্নয়ন ও জনগণের সেবা ত্বরান্বিত হবে। শুধু আইনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের গোপনে শাস্তি দিয়ে নয়; প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়ে, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে সকলের মধ্যে ভীতি ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। সৎ ও আদর্শের মনোভাব নিয়ে ধর্মীয় বাণীকে হৃদয়ে ধারন করে কাজ করে যেতে হবে।
এ বি এম ফয়েজুর রহমান : সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর
টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টি টি সি)
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]