শনিবার ভোর ৫:৩৫, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

বাংলা নববর্ষ উৎসব : আমার ছোটবেলা ও ভাদুঘরের বান্নী

১২৭৪ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

বাঙালীর একান্ত নিজস্ব উৎসব বাংলা নববর্ষ- এই উৎসব বাংলা ভাষাভাষীদের একটি সর্বজনীন নিজস্ব উৎসব। বাংলা সনের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালী এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভূলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের দুঃখ-গ্লানি এবং সব বাঙালীরই কামনা বছরটি যেন সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়।  বাংলা নববষের্র অন্যতম আকর্ষন হচ্ছে বৈশাখী মেলা, বাংলাদেশ জুড়ে বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই ছোট-বড় কতই না মেলা বসে। সাধারনত মেলা গুলোর স্থায়িত্ব হয় এক থেকে সাত দিন। কোথাও আবার মেলা চলে মাস ব্যাপী। স্থানীয়রাই এসব মেলার আয়োজন করে থাকে। এসব মেলার সূচনা হয়েছে কয়েকশ বছর আগে থেকেই। নতুন বছরের আনন্দ আরও প্রানময় করে তুলতে এসব মেলা সামাজিক ও বানিজ্যিক ভাবে চলছে বহু যুগ ধরে। স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত ব্যবহার যোগ্য পন্য ও খাবারের পসরা নিয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে গ্রামীন মেলা। বিক্রি হয় কুটির শিল্প, হস্তশিল্প দ্রব্য এবং কৃষিপন্য। নিত্যপয়োজনীয় দ্রব্য এ সময়ে অত্যন্ত কম দামে হাতের কাছে পাওয়া যায়। বৈশাখী মেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিক্রয় যোগ্য পন্য হলো বিভিন্ন ধরণের খাবার-দাবার, মুড়ি-মুরকি, পিঠা, হালুয়া, পায়েস, নাড়ু–, বাতাসা, কটকটি, তিল্লাই, আচারসহ আরও নানান ধরনের খাবার ও পন্য মেলায় পাওয়া যায়। বৈশাখী মেলা সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের বিস্তৃর্ন খোলা স্থানে। বিশেষ করে বড় ধরনের বট গাছের নিচে বসে এই মেলা। কিন্তু বর্তমানে লোকালয়ের বিস্তার এবং নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তেমন খোলা পরিসর না থাকায় নদী তীরবর্তী স্থান, বাজার,  পুকুরের পার বা গ্রামের বিদ্যালয়ের মাঠেই অনুষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে অন্যান্য ঋতুর চেয়ে হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত কালে শত শত মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এসব মেলা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-দিনাজপুরের কান্তজীর মেলা, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মেলা, চট্টগ্রামের মাইজভান্ডর মেলা, বগুড়ার পোড়াদহের চড়ক মেলা, আখাউড়ার খরমপুরের মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘরের বৈশাখী মেলা ইত্যাদি।

আমার শৈশব ও কৈশোর জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে আবহমান বাংলার এসব মেলা বা বান্নী গুলোকে কেন্দ্র করে। এসব স্মৃতি আজও আমাকে রোমাঞ্চিত করে। তখন আমার বয়স প্রায় ৭/৮ বছর। সম্ভবত আজ থেকে ৩৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে আমার আব্বার চাকুরীর সুবাদে আমরা শ্রীমঙ্গল শহরের রেলওয়ে পশ্চিমে কালোনীতে থাকতাম; বৈশাখী মেলা উদযাপন উপলক্ষে আমরা সপরিবারে প্রতি বৎসরই শ্রীমঙ্গল থেকে কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেনে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বড়খালা হাজেরা খাতুনের ভাদুঘরের বাড়ীতে আসতাম। শ্রীমঙ্গল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসা-যাওয়ার জন্যে লোকাল ট্রেনই ছিলো তখন একমাত্র ব্যবস্থা। খালার বাড়ীর পূর্ব পর্শ্বে অবস্থিত ভাদুঘরের ঐতিহাসিক মেলার মাঠ। লোকমুখে শোনা যায় আল্লাহর ১২ জন ওলী- ধর্ম প্রচারক উক্ত স্থনে একত্রে বসে ধর্ম প্রচার বিষয়ে সালা-পরামর্শ করতেন। তাদের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যেই পরবর্তীকালে এ মেলার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় লোকসংখ্যা কম ছিল বলে ঘর বাড়ী ও তেমন ছিলনা । তবে সামান্য কয়েকটি পাঁকা বাড়ি ও টিনের ঘর ছিল। সে কারণে মাঠের পর মাঠ খালি পড়ে থাকত। বট গাছসহ বিভিন্ন রকমের গাছ গাছরার পাশেই ছির তিতাস নদীর শাখা। প্রতি বছর এখানেই ১৪ ই বৈশাখ মেলা বসত এবং এখনও বসে। এই ঐতিহ্যবাহী মেলা চলত মাত্র একদিন কিন্তু মেলার আমেজ থাকত প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত ।  ভদুঘরের বৈশাখী মেলায় আসত আস পাশের গ্রাম ও দূর দুরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ। এই মানুষগুলো মধ্যে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, সবাই থাকত। নায়র-নায়রীদের এ সময় আসার ধুম পড়ে যেত। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে বিভিন্ন কারণে ভাদুঘরের এই ঐতিহাসিক মেলায় আগে মতো আর লোক সমাগম হয় না।

এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে; কাক ডাকা ভোরে ঢুলির “টাকডুম” ঢুলের শব্দ শোনা মাত্রই আমার সমবয়সী খালাতো ভাই-বোন আলমিনা, মিতা, নাসিমা, রেজা, বাসেদ, ইয়াসিনসহ অনেকে একসাথে দল বেধেঁ মেলার মাঠে চলে আসতাম এবং দেখতাম সনাতন ধর্মের অনুসারী আবাল বৃদ্ধবণিতারা দল বেধেঁ সূর্যকে প্রণাম করে তিতাস নদীতে নেমে গঙ্গাস্নান করছে। আমাদের উপস্থিতি আঁচ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা পরস্পরের সঙ্গে বলাবলী করছে যবনরা (মুসলমানরা) ছুঁলে অপবিত্র হয়ে যাবো, তারাতারি স্নান শেষ কর। তাদের এ ধরনের অপ্রত্যাশিত সংলাপ শোনার পর  মনক্ষুন্ন হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমরা  সবাই বাড়ীতে ফিরে  আসতাম এবং এসেদেখতাম বড় খালা ও আমার আম্মা জাহানারা খাতুন অনেক গুলো শুকনো লতা-পাতায় আগুন দিয়ে ধুয়া তৈরী করে ওগুলো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে হিন্দু বাড়ী গুলোর দিকে প্রেরন করছেন এবং দ্বৈত কন্ঠে মৃদু স্বারে বলছেন – “মুসলমান বাড়ীর দুঃখ-কষ্ট হিন্দু বাড়ীতে যা আর হিন্দু বাড়ীর সুখ-শান্তি মুসলমান বাড়ীর দিকে আ”। এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আম্মা ও খালারা আমাদের সবাইকে একটু একটু করে চিরতা ভেজা পানি খেতে দিতেন। এর কারণ জানতে চাইলে মা বলেছিলেন, এদিনে তেতো খেলে সারা বছর তার কোনো অসুখ হয়না। মা আরো বলেছিলেন, এদিনে কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে নেই। মন খারাপ করতে নেই। সব সময় হাসি মুখে থাকতে হয়। তারপর আমরা সকালের নাস্তা করতে দস্তরখানায় বসলাম, দেখলাম সকালের নাস্তায় রকমারি পিঠা-পুলির আয়োজন। দুপুর ও রাত্রির খাবারের হরেকরকম রান্নার জোগাড় নিয়া মহাব্যস্ত মা-খালারা, তাদের কাছে থেকে জানতে পারলাম- দুপুরের খাবারের তালিকায় থাকবে,হেলেনচ্ছা, গিমাই, সহ ১২ রকমের শাক; করলা, নিমপাতা শুকনো পাটশাকসহ ৩ পদের ভাজি। কালিজিরা, শর্ষে, তিল, গোল আলু, রসুন সহ ৫ ধরনের ভর্তা । তার সঙ্গে আমের চাটনি। এছাড়াও বাউস মাছের শুকনা ভাজি, চিতল মাছের কুপ্তা। আর রাতের আয়োজন থাকবে মুরগীর কুরমা, পাংগাশ মাছের ঝাল ফ্রাই, গরুর ভোনা মাংশ, কলাসহ দুধভাত। সবশেষে খালার হাতের চিনি পাতা দই। এধরনের মহাভোজের আয়েজন দেখে মা-খালাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আজ তোমরা কেন এত খাবার বানাচ্ছ ? তখন তারা বললো, এই দিনে ভালো খাবার খেলে সারা বছরই ভালো খাওয়া যায়। এসব কথা আজ ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।

মেলা উপলক্ষে ভাদুঘরের মেলার মাঠে আসপাশের গ্রাম ও দূর-দূরান্ত থেকে আসতো অগনিত দোকানি। এ সময় সূর্য্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে মেলার মাঠজুরে থরে থরে বসত দোকানিরা; বেদেনিরা শরীরের বিষ-বাতের ব্যথার ঔষধী গাছ-গাছরার শিকড়-বাকর ও চুড়ি-ফিতার দোকন নিয়ে বসত এক পাশে। তারপরের সারিতে বসত বাতাশা-খুরমা, মোয়া-মুড়ি, চিড়া-খই, মুড়কি-পিঠা, দই-দধির দোকান। অন্যদিকে বাশেঁর বাঁশি, একতারা, দোতারা, ঢোল ও অন্যান্য বাদ্য যন্ত্র নিয়ে বসত দোকানিরা। বসত কুলা, চালুন, ঝাড়–, মাছ ধরার নানা সরঞ্জামের দোকান। মেলা শুরু হতো সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে আর চলত রাত্রি পযর্ন্ত। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে বড় বড় কুপি বাতি, হ্যাজাক বাতি জ্বালাত দোকানিরা আর মেলায় আগত ক্রেতা ও উৎসুক দর্শকদের অনেকের হাতে থাকত টচলাইট। কেউ কেউ হ্যরিকেন বাতিও সঙ্গে রাখত। সন্ধার পরপরই মেলায় এক কোনায় গাছের তলায় বসত জুয়ার আসর। জুয়ারিয়া আসত বিভিন্ন স্থান থেকে। তবে মাঝে মধ্যে জুয়ার টাকা নিয়ে জুয়ারীদের মধ্যে তুমুল কলহ সৃষ্টি হতো। এই কলহ অবশ্য স্থায়ীয়দের মধ্যস্থতায় শেষ হয়ে যেতো।

ঐতিহ্যবাহি ভাদুঘরের মেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল কঠের তৈরী আসবাবপত্র ও ফানির্চার। এ গুলোরে মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ছিল- গাইল-ছাহাইট, ঢেকি, নকশীকরা বাদশাহী পালংক, শাহী আলমারী, নবাবী সিন্ধুক, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি। এসব ফার্নিচারের কারিগররা ছিলেন খুবই দক্ষ। বর্তমানে এ ধরনের দক্ষ কারিগর সচরাচর দেখা যায়না। কাঠের দোকানে গুলোর পরের সারিতে বসতো কামারের দোকান। দোকানীরা থরে থরে সাজিয়ে রাখতো লোহা, পিতল ও কাসার তৈরী বিভিন্ন ধরনের মনহরনকারী তৈজসপত্র । আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার অনেক পিরাপিরীতে আব্বা দোকানীর কাছ থেকে এক জোড়া আতর ও সুরমাদানী কিনে দিয়ে ছিলেন। উক্ত দু’টি জিনিস আজও আমার কাছে আছে। মেলার বিভিন্ন তৈজসপত্রের দোকন গুলো তন্ন তন্ন করে দেখা সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা দল বেধেঁ ছুটে যেতাম মেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় খেলা বায়োস্কব ও পুতুল নাচ দেখতে। জীবনে এই প্রথম আমি বায়োস্কব দেখী। বায়োস্কব ওয়ালা ছবির সঙ্গে মিল রেখে গান গেয়ে ধারাবাহিক ভাবে দেখালেন- আগ্রার তাজমহল, দিল্লীর কুতুবমিনার, শায়েস্তা খানের লালবাগের কেল্লা, সোনার গায়ের পানাম শহর, সদর ঘাটের বাহদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জীল ইত্যাদি। বায়োস্কব দেখা শেষ হওয়ার পর আমরা দল বেঁধে ছুটে চললাম তৎকালীন ব্রাহ্মবাড়িয়ার বিখ্যাত “ঝুমুর বীনা পুতুল নাচ” দলের প্রদশর্নী দেখতে। এই দলের পরিচালক তারামিয়া এমন চমৎকার ভাবে রামায়ন মহাকাব্যের “সিতাহরন” গল্পটি প্রদর্শন করলেন যা দেখে আমরা বিমুগ্ধ হয়ে ছিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, কাঠ, বাশঁ, বেত, পিতল ও লোহার তৈরী আসবাপত্র বেচা-কেনা ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী ভাদুঘরের মেলায় অতিক্ষুদ্র পরিসরে বসত গানের আসর। মনোমহনদত্ত, লালন শাহ ও হাসন রাজার গান গাইত স্থানীয় বয়াতিরা। কোনো উচুঁ মঞ্চে নয় শুধু গাছের গোড়ায় বসে এক তারা, দু’তারা, ডুগডগি, খোল, ঢোল ও বাশেঁর বাঁশি বাজিয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে ফেরত তারা।

সন্ধা হওয়ার পরপরই মেলায় স্থানীয়দের সমাগম বেশী হতো এবং এ সময় বিভিন্ন ধরনের খেলা গুলো প্রায় শেষ হয়ে যেতো। মেলায় সব ধরনের খেলা ও প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর আব্বা আমাকে হাত ধরে অতি সাবধানে নিয়ে যেত মেলার ভিতরে; বলতেন কি খাবা বাবা? বাতাশা, খুরমা, তিল্লাই, গাজা, জিলাপী, বাশিঁ, বেলুন,খেলনা বন্দুক, এসব দেখিয়ে বলতাম প্রত্যেকটাই চাই।   আব্বা আমার বায়না অনুযায়ী সবই কিনে দিতেন আর বাসার জন্য কিনে নিতেন গৃহস্থালী সামগ্রী। কেনা জিনিস ও খাবার গুলো পেয়ে আমি খুশিতে এমন আত্মহারা হয়ে যেতাম-যেন সাত রাজার গুপ্তধন পেয়েছি! এগুলো নিয়ে আব্বার হাত ধরে মানুষের ভির ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে আসতাম মজার মেলা থেকে। খালুর বাড়িতে যখন আসতাম তখন রাত। বাড়ির সবাই মেলা থেকে আনা খাবার ও খেলনা দেখার জন্য পুলস্থুল বাধিয়ে দিত। আম্মা ধীরে ধীরে বের করে সবাইকে দেখাতেন এবং খাবার গুলো খেতে দিতেন। রাতের খাবারের পর বড় খালু নুরুল হক সাহেবের বৈঠক খানায় বসত বাউল গান ও পুথিঁ পাঠের আসর। স্থানীয় গায়েন ও কবিয়ালরা উক্ত আসরে আসতেন ও গান পরিবেশন করতেন। বাউল শিল্পীরা সাধারনত খালেক দেওয়ান, শাহ আবদুল করিম, উকিল মুন্সি, কুটি মনসুর, মনমোহনদত্ত, লালন শাহ ইত্যাদি সাধকদের রচিত গানই বেশী করে গাইতেন। বাউল গানের আসর শেষ হওয়ার পর পরই বড় খালা বিভিন্ন পদের পিঠা-পুলি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়িত করতেন। আর এরই মধ্যে শুরু হয়ে যেত কবিতা আবৃত্তির আসর। কায়কোবাদ, নজরুল, ফররুখ আহমেদ, জীবনান্দ দাস, ইত্যাদি কবিদের বিখ্যাত কবিতা গুলো আবৃত্তি করতেন আমার বড় ভাই সামসুল আবরার খান, খালাতো ভাই নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, আব্দুল বকি সরকার, হেদায়েতুল হক সহ আরো অনেকে। সবশেষে অনুষ্ঠিত হতো অনুষ্ঠানের মুল আকর্ষণ পুথিঁ পাঠের আসর। স্থানীয় কবিয়ালরা মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্য থেকে ক্রমান্বয়ে পাঠ শুরু করতেন ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, হাতেম-তায়ী, শহিদে কারবালা, মহুয়া সুন্দরী ইত্যাদি কাহিনী। ভোর পর্যন্ত চলতো এই পুথিঁ পাঠের আসর। আমরা ছোটরা রাত দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সজাগ থাকতাম।

ভাদুঘরের বৈশাখী মেলা উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে বড় খালার বাড়ীতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসতেন। এই অতিথিরা প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করতেন। এই মেলা যেন আত্মীয়-স্বজনদের এক মহা-মিলন মেলায় পরিনত হতো। এই মিলন মেলার আনন্দ-উল্লাস অন্যান্য উৎসব পাবর্ণকেও হার মানাতো। আব্বার চাকুরীর সুবাদে শৈশব ও কৈশোর কালে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি এবং বিভিন্ন মেলায় গিয়ে তা উপভোগ করেছি কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘরের বৈশাখী মেলা বা বান্নীর মতো এমন আনন্দ ও উচ্ছাস কোথাও পাইনি। বাস্তবেই ঐতিহ্যবাহি-ঐতিহাসিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘরের মেলা অনন্য ও অতুলনীয়।

আবহমান বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব হলো বাংলা নববর্ষের বৈশাখী মেলা। এই মেলা মানুষে মানুষে মিলনের, সাংস্কৃতিতে সাংস্কৃতিতে সংযোগের ও শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখছে। সুতরাং বাঙ্গালীর ঐতিহ্যগত এই বৈশাখী মেলা প্রকৃত অর্থেই হউক বাঙ্গালী জাতির সম্প্রীতির ধারক ও বাহক।

খায়রুল আকরাম খান : ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন

Some text

ক্যাটাগরি: সাহিত্য, স্মৃতিচারণ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি