বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়। এটি বাংলাদেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। মূলত সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই সংস্থাটি সমন্বয় সাধন করে থাকে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ২০১৯ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১৫০ টি। এর মধ্যে সরকারি ৪৫টি, বেসরকারি ১০৩টি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ২টি। বস্তুত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার, সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা এবং বিকাশ ঘটানো। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চাশিক্ষার মানরক্ষা, অবৈধকাজ দমন এবং নিয়ন্ত্রণ এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদেরদেশ উচ্চাশিক্ষার প্রসার ও বিকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠান সরকারকে সামগ্রিক পরামর্শ দিয়ে থাকে। প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা বিকাশের বৃহত্তর স্বার্থে এতৎ সংক্রান্ত কাজের যাবতীয় বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্যে সরাসরি সরকার বাহাদুরের সাবির্ক সহযোগিতা নিতে পারে।
এতো প্রভূত ক্ষমতা থাকার পরও গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন(ইউজিসি) গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সর্তকবার্তা দিয়েছে, যদিও ২৫ টি উচ্চাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের এ বার্তা দেওয়ারই আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে যেকোনো ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে বা শিক্ষাকার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হলে তার দায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নিবে না। এদায় একতরফাভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেই নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের এই ধরনের গণবিজ্ঞপ্তি পূর্বেও বহুবার প্রকাশিত হয়েছে,কিন্তু কাজের কাজ কিছু্-ই হয়নি। এধরনের গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে ইউজিসি নিজেদের অসহায়ত্বই প্রকাশ করল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সর্তক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে ইউজিসি দায় শেষ করলেও এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনকানুন তথা নীতিনিয়ম মেনে চলছে কি না,সেটা দেখার এবং তদারকি করার দায়দায়িত্ব তাহলে কার? একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে ভর্তি হতে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। এটা অবাস্তসম্মত কথা! কোন বিশ্ববিদ্যালয় কোন শর্ত লঙ্ঘন করছে, কার কোন কোন বিষেয়ে অনুমোদন নেই, তা কি একজন সাধারন শিক্ষার্থীর বা তার অভিভাবকের পক্ষে জানা-বোঝা সম্ভব? এর যথাযথ উত্তর হচ্ছে মোটে-ই না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে মূলত শিক্ষার চেয়ে ব্যবসায়িক মনোভাবই বেশি থাকে। শিক্ষাবিস্তার, শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করা কিংবা শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করার সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে যতটা, তার চেয়ে অধিক আগ্রহ থাকে মুনাফা লুটার প্রতি। এসব মুনাফা লোভীরা নানা ফঁন্দি-ফিকির করে ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রয়োজনীয়তার কথা না ভেবে একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে এক ধরনের জটলার সৃষ্টি করেছে।
বস্তুত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার আগেই এর সক্ষমতার বিষয়গুলো নজরে রাখার দায়িত্ব যেসব সরকারি বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের, তারা তা যথাযথভাবে করছে না। শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শর্ত মানতে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে স্বস্তি বা নিজেদেরকে রক্ষা পাওয়ার পন্থা খুঁজতে চাইলে তা চলবে কেন?
শিক্ষার মান বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়ে চমক সৃষ্টির এক ধরনরে প্রবণতা আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সব সময়ই। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এধরনের প্রবণতা তাদের পরিত্যাগ করা উচিৎ। আমাদের দেশের একসময়কার নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখন যেখানে মানের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে, সেখানে এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হল কেন?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশির ভাগ-ই বছরের পর বছর বিভিন্ন শর্ত ভঙ্গ করে চলছে, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার পদে নিয়োগ না দিয়ে কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় না এনে শিক্ষার্থীদেরকে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সর্তক করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বাস্তবে নিজেদের অসহায়ত্বই প্রকাশ করল।
পরিশেষে বলতে চাই, যেহেতু আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম এবং উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী সব শিক্ষার্থীরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পন না, সেহেতু মানসম্মত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার রয়েছে। তবে সেটি যাতে মুনাফা ও সনদ-বাণিজ্যের সংস্থায় পরিণত না হয়, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যায় মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই। সুতরাং শুধু পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষার্থীকে সর্তক করলেই ইউজিসির দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। আইন অনুযায়ী, সব সরকারি-বেসরকারি পরিচালনা করা তাদের প্রধানতম কাজ। এই গুরুতর ও মহত্তর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
Some text
ক্যাটাগরি: চিন্তা, নিয়ম-কানুন, মতামত
[sharethis-inline-buttons]