গতকাল রবিবার (১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ইং) সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দীর্ঘ দেড় বছর পর দেশের সকল স্কুল-কলেজ খুলেছে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে শুরুতে স্কুল-কলেজে ১৪ দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ ভুলেও ভাবেনি এই ছুটি প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হবে।
সরকারের তরফ থেকে স্কুল-কলেজ খোলার জন্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীরা সমাজিক দূরত্ব অটুট রেখে যেন শ্রেণিকক্ষে বসতে পারে, সেভাবে আসনের ব্যবস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে করতে হবে। ভিড় বা কোনো ধরনের জমায়েত এড়াতে স্কুল-কলেজে আপাতত অ্যাসেম্বলি বন্ধ থাকবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আলাদা রাখতে হবে। আর প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অবশ্যই মাস্ক পরে যার যার প্রতিষ্ঠানে আসতে হবে।
গতকাল রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার কয়েকটি স্কুল-কলেজে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্কুল-কলেজই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূর্যমুখী কিন্ডাগার্টেন। সরেজমিনে দেখা যায়, স্কুলটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। শিশুদের মনে আনন্দ দেওয়ার জন্যে পুরো বারান্দায় রং-বেরং এর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। বন্যা নামে চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, দীর্ঘদিন স্কুলে আসার পর তার ভালো লাগছে। পুরানো বন্ধুদেরকে কাছে পেয়ে সে মহাখুশি।
তারানা নামে তার আরেক সঙ্গী দুঃখ করে জানান, দীর্ঘদিন পর সহপাঠিীদের সাথে দেখা হয়েছে। অথচ তাদের সাথে একত্রে বসে টিফিন খেতে পারবো না এবং খেলাধুলা করতে শিক্ষকরা বারন করেছেন। এটা আমাদের জন্যে দুঃখজনক। তারপরও স্কুল খোলাতে আমার খুবই আনন্দিত।
সূর্যমুমী স্কুলের পশ্চিম-উত্তর পাশেই বিখ্যাত অন্নদা সরকারি হাই স্কুল। উক্ত স্কুল প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্ররা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ও মুখে মাস্ক পরে স্কুলে প্রবেশ করছে। আর স্কুলের দুজন শিক্ষক তাপমাপার যন্ত্র দিয়ে প্রতিটি ছাত্রের তাপমাত্রা পরিমাপ করছেন। আরেক শিক্ষক মাইকিং করে সকল ছাত্রদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা নাজমীন ছাত্র ও শিক্ষকদের যাবতীয় কাজ তদারক করছেন।
এ প্রতিষ্ঠানের সিনিয়ক শিক্ষক সফিউর রহমান বলেন, ‘সরকার থেকে যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমরা তার চেয়ে বেশি প্রস্তুতি নিয়েছি। ছাত্রদের স্কুলে এসে ক্লাস করতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না ইন্নশাআল্লাহ। এই প্রতিষ্ঠানের অতিসন্নিকটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাই স্কুল অবস্থিত। উক্ত স্কুলের চিত্রও একই ধরনে। স্কুলের প্রধান মোঃ মোস্তফা কামালের কাছ থেকে জানা যায়, স্কুলে ৫০% ছাত্র আজ উপস্থিত হয়েছে। তিনি আরো জানান, আশা কারা যায় এই উপস্থিতির ৮০% পর্যন্ত পৌঁছবে।
স্কুলের বারান্দায় কথা হয়, বশির আহমেদ নামে নবম শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি তার ছেলের অ্যাসইনমেন্ট জমা দিতে শেরপুর থেকে এসেছেন। তার মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও আগেই খুলে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ এ দীর্ঘ সময়ে তার ছেলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ভিডিও গেমে আসক্তি বেড়েছে। পড়ালেখায় মনযোগ হারিয়ে তাকে নিয়ে রীতিমতো ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। তবে বিদ্যালয়ে যাতে স্বাস্থ্য সচেনতা ভেঙ্গে না পড়ে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধন জানান বশির আহমেদ।
প্রায় একই চিত্র আনন্দময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। অনেক শিক্ষার্থীই আজ এসছে বিদ্যালয়ে। সবার মেজাজ ফুরফুরে। তবে এদের মধ্যে তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘অনলাইনে পড়ালেখা হয়েছে কিন্তু সেটা ছিল বিরক্তিকর। সারাদিন ল্যাপটপ, মোবাইলের ভেতর থাকতে থাকতে জীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। এটা থেকে মুক্তির দরকার ছিল। স্কুল খুলছে, তাই মনে দারুন আনন্দ লাগছে।’
কুমারশীল মোড়ে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজ। এই কলেজের চারদিকে সাজ সাজ রব। এই কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ এস এস শফিকুল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থী হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ। দীর্ঘদিন পর আজ কলেজ খুলেছে, আমরা শিক্ষার্থীদের দেখছি, তাদেরকে নিয়ে ক্লাস করছি। এ এক অন্য রকম আনন্দ। কলেজের বিজ্ঞান ভবনের গাছের নিচে মুখে মাস্ক পরে শেফালি, জুঁই ও বিলকিস নামে তিন বান্ধবী চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের আড্ডার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন তারা গৃহে বন্দী ছিল, এখন তারা প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
আব্দুল হালিম নামে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, এই দেড় বছর আমার দুশ্চিতায় পার হইছে। গ্রামে তো শহরের মতো করোনা নাই। এরপরও আমাদের মেয়েগুলোর বিরাট ক্ষতি করা হলো। অনেকে মেয়েদের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কারণ মেয়েদেরকে তো আর বসিয়ে রাখা যায় না। কলেজ খোলার খবরে আমাদের মধ্যে স্বস্তি এসছে। পরিস্থিতি যা হোক, কলেজ আর কোনোভাবেই যাতে বন্ধ না হয়। তিনি আরো বলেন, গোটা দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চেয়ে উত্তম সমাধান আর কিছুই হতে পারে না।
মেড্ডা রোডের অতি নিকটে রামকানাই হাই একাডেমি। এই বিদ্যালয়ে গত বছর ৬ ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছিল আবু হানিফা। সে জানায়, বর্তমানে তার পেশা মাইক্রো চালকের সহকারী। আজ স্কুল প্রাঙ্গনে কথা হয় আবু হানিফার সাথে। সে জানায়, তার বাবা নেই, মা গৃহকর্মী। তার আয়ের ওপর পরিবারের খাওয়া-পরা নির্ভর করছে। আনন্দবাজারের একটি মাছের দোকানে মাছ কাটার কাজ করে এই স্কুলের আরেক ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আবির হোসেন। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় মাছের দোকানে কাজ নেয় সে। দৈনিক আয় ২৫০ টাকার মতো। আবির হোসেন বলেছে, তার আর স্কুলে যাওয়া হবে না। পরিবার এখন তার আয়ের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। এখন হঠাৎ আয় বন্ধ করে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টারের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এই জড়িপ পরিচালিত হয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের এই ঝড়ে পড়া রোধ করাটাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় ভাবনায় ফেলেছে শিক্ষক ও সরকারের শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও। শিক্ষাবিদরা এই প্রসঙ্গে বলছেন, গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধান করে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
খায়রুল আকরাম খান: নিজস্ব প্রতিবেদক
ক্যাটাগরি: প্রধান খবর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শীর্ষ তিন
[sharethis-inline-buttons]