আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, নাকি তৃতীয় ঢেউ, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে এটা যদি দ্বিতীয় ঢেউ চলে,তহালে তৃতীয় ঢেউ হয়তো আরো প্রকট ও ভয়াবহ হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণ খুবই আতংকের মধ্যে আছেন। কিন্তু আমাদের দেশে জীব বিজ্ঞানীর সুনির্দষ্টি করে কিছু বলতে পারছে না। তবে তারা এ ব্যাপার খুব উৎকন্ঠার মধ্যে আছেন।
বস্তুত ২০২০ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ছুটি-লকডাউন-শাটডাউন-কঠোর লকডাউন-কড়াকড়ি শাটডাউন এসবের মধ্যে দিয়েই দেশ অতিবাহিত হচ্ছে। মহামারীর পূর্বে আমাদের দেশের জনগণ এসব শব্দের সঙ্গে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। জনগণ এসব জীবনধারার সাথে এখনো পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাই করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না।
কিন্তু সরকারবাহাদুর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রেণে আনার জন্য চলিত বছরের ফেব্রুয়ারীর শুরুতে জনগণে মাঝে কভিডের ভ্যাকসি প্রয়োগ শুরু করে। তবে এই টিকা সংগ্রহ,বিতরন ও প্রয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে নানান জটিলতা ও বির্তক। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতার অভিযোগও আছে প্রচুর। যেখানে আপাতত সাড়ে ১৬ কোটি জনগণের জন্য টিকা সংগ্রহ করা দরকার ২৬ কোটি ডোজ, সেখানে নিজস্ব ক্রয় ও অনুদান বাবদ প্রায় ২ কোটি ডোজও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এটা সরকার বাহাদুরের বিরাট ব্যর্থতা।
আর দফায় দফায় লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ চললেও সেটা যথাযথভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। লকডাউন হচ্ছে আবার লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে। আবার গ্রাম থেকে শহরে আসছে। তারা পেটের দায়ে এভাবে গ্রাম ও শহরে আসা-যাওয়ায় বাধ্য হচ্ছে। কে কোথায় কেমন করে যাবে, যাতায়ত ভাড়া কত পড়বে তার কোনো ধরনের ধারণা নেই তাদের। সুতরাং কোনোরকম ধারণা ছাড়াই সে পথে নামতে হচ্ছে মানুষকে। এই সুযোগে অতি মুনাফা লোভী লোকেরা ফাঁদ পেতে বসে আছে অসহায় মানুষগুলোর টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যে। এযেন রামরাজত্ব! বলার কিছুই নেই। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা,ভেনগাড়ি,হেটে,ট্রাকে, গাদাগাদি করে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েও অসহায় মানুষকে গুনতে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত-আটগুন বেশি ভাড়া। এভাবে বারবার জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টসকর্মীসহ অন্যান্য পেশার শ্রমজীবী আর নিম্ন আয়ের মানুষদের দফায় দফায় ছুটোছুটি করতে হচ্ছে রাজধানী আর বড় বড় শহর থেকে গ্রামে আর গ্রাম থেকে পুনরায় শহরে। এতে করোনার সংক্রমণও দফায় দফায় ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র।
গত দেড় বছরে অসংখ্যবার বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বলা হচ্ছে। তারপরও সর্বসাধারণের সুবিধার্থে আবারও বলছি-সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন না হলে এই ভয়াবহ মহামারীকে ঠেকানোর বিকল্প কোনো পথ নেই। ভাবতে অবাক লাগে এই ভয়াবহ অবস্থায়ও দেশের বেশিরভাগ মানুষ ঠিকমতো মাস্ক পরেন না। কিছু কিছু লোক আবার স্টাইল করে থুতনির নিচে মাস্ক পরেন। জিজ্ঞাসা করলে বলে, মাস্ক মুখে লাগালে শ্বাসকষ্ট লাগে। মাস্ক না পরার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলেন না। শহর-শহরতলিতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা মানলেও, গ্রামগঞ্জে নিয়ম মানার কোনো বালাই নেই। গলি,মহল্লাহ ও গ্রামের দোকানপাট,হাটবাজারে গাদাগাদি করে চলাফেরা করছে। এসব জায়গায় উপচে পরা ভিড় লেগেই আছে। তবে একথা ঠিক যে,দীর্ঘদিন ঘরে থাকতে থাকতে মানুষের মধ্যে একঘেয়েমি ও বিরক্তি চলে আসে। তাই এই একঘেয়েমি ও বিরক্তিভাব দূর করার সুযোগ খুজতে থাকে। আর তখন সামান্য সুযোগ পেলেই বিভিন্ন বাহানায় বিধিনিষেধ ভুলে পথে নেমে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু সবাইকে এসময় ভাবতে হবে-আমাদের দেশে করোনার বিপদ এখনো কাটেনি। প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যাই তার উপযুক্ত প্রমাণ।
এই ভয়াবহ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি ভুলে নিজের খুশী মতো চলাফেরা করলে বিপদের মাত্রা আরো বাড়বে। এই অবস্থায় অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সামাজিক দূরত্ব অটুট রাখা,হাত ধোয়া,স্যানিটাইজার ব্যবহার করা,হাচি বা কাশি দেওয়ার সময় মুখে টিস্যুপেপার বা রুমাল ব্যবহার করা এবং বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মুখে মাস্ক ব্যবহার করা। আর এসব নিয়মানুযায়ী জীবনযাপন করতে পারলে আশা করা যায়-করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। তাই নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্যে এক্ষেত্রে সব ধরনের গাফিলতি অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
পাশাপাশি সবাইকে এ কথাও সব সময় মনে রাখতে হবে, জীবন চলমান-মহামারীর কারণে জীবন থেমে থাকবে না। এই অবস্থয় মনে অদম্য সাহস রেখে ভয়ডর দূর করে পেশাগত জীবন ও পারিবারিক জীবন চালিয়ে যেতে হবে। তবে শর্ত স্বাস্থ্যবিধি অটুট রাখতে হবে।
তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করা শ্রমজীবী ও অতিদরিদ্র মানুষের জন্যে খুব কঠিক ও দুস্কর ব্যাপার। এক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার জন্যে আমাদের সবার সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রয়োজনে এসব শ্রমজীবীদের সঠিক তালিকা করে তাদের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। সরকার বাহাদুরকে একথা সব সময়ই খেয়াল রাখতে হবে-শ্রমজীবী ও অতিদরিদ্রদেরকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ তাদেকে অনাহারে রেখে করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার আশায় স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের জন্যে দফায় দফায় যতই লকডাউন-শাটডাউন-কড়াকড়ি শাটডাউন দেওয়া হউক না-কেন তা কখানো ফলপ্রসূ হবে না।
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আমাদের সমাজে যারা `নাগরিক সমাজের` নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা হয় সরকারের অনুগত, তা না হলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হয়েছেন। অথবা অন্যকোনো দল বা মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী সমাজ। সাংবাদিক সমাজ। শিক্ষক সমাজ। চিকিৎসক সমাজ। আইনজীবীসহ প্রায় সব স্তরেই দেখা যাচ্ছে প্রায় একই পরিস্থিতি। নাগরিক সমাজের লোকেরা ক্ষতায় আসতে চায় না, তবে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে চান। জনগণের কল্যাণ চান। সরকারের সুবিধার্থে রাষ্ট্রের অনংলগ্নতাগুলোকে তুলে ধরেন। তাদের নিকট জনগণের এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু এবার জাতীয় এই সংকটকালে একান্ত ইচ্ছা থাকার পরও সরকারের দলীয় ও একঘেয়েমি নীতির কারণে তারা যথাযথভাবে আগের মতো অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারছেনা।
করোনার সংক্রমণ থেকে সত্যিকারভাবে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দেশের জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে উদার মন নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। তবে জনগণ যদি সর্তক ও সংগঠিত না হয়, তাহলে শুধু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে খুব বেশি কিছু হবে না।
সুতরাং করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্যে সরকার বাহাদুরের উচিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে দ্রুত একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা এবং উক্ত কমিটির সর্বসম্মত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা।
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]