যথার্থ মনুষ্যত্ব অর্জন করে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অরিসীম। শিক্ষা মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশ ঘটায়। শিক্ষা মানুষকে জীবন ও জগৎকে যথাযথভাবে চিনতে শেখায়। শিক্ষা জাতির উন্নতি সাধন করে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড-এ কথাটি চিরন্তন সত্য। কেবল মাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতি পেতে পারে সঠিক পথের সোনালী ভবিষ্যৎ। সেই প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত যেসব জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করতে পেরেছে তার মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা এমন একটি সম্মোহনীয় শক্তি যা, মানুষের জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটায়। এই জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের জাতি বা গোষ্ঠীর মানুষ যেকোনো প্রান্ত গিয়ে মানব সেবায় যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই মানবের মাঝে এই জ্ঞানশক্তি বিতরনের একমাত্র মাধ্যম।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমনের কারণে গত দেড় বছর যাবৎ আমাদের দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগাতারভাবে বন্ধ হয়ে আছে, একবারের জন্যও খোলা হয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থী যারা, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন তাদের প্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়নি এই করোনাকালীন সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক আবেদন-নিবেদনের পর চলিত বছরের মার্চ মাসে সরকার সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যায় ও ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষাগুলো নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করে। সরকারের নির্দেশের পর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনার্স ও মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলো শুরু হয়, কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমন বৃদ্ধির কথা বলে সরকার চলমান পরীক্ষাগুলো স্থগিত করে দেয়। তারপর সরকারের পুনঃনির্দেশে উক্ত স্থগিতকৃত পরীক্ষাগুলো মে মাসের প্রথমদিকে পুনরায় শুরু হয়,কিন্তু হ্যায়! এ বারও একই কথা বলে সরকার উক্ত পরীক্ষাগুলোর শেষ পযার্য়ে তা স্থগিত করে দেয়। তবে অতি অল্প সংখ্যক কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত পরীক্ষা চালু রাখে। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা বিরাট সেশন জটের ফাঁদে আটকা পরে। শিক্ষার্থীদের সাথে সরকারের এ ধরনের খামখেয়ালিপনা সত্যিই অমানবিক!
সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে,বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় এনে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়,জাতিয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারী বিশ্বদ্যিালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী, করোনার টিকা পেতে হলে টিকা প্রার্থীর বয়স ২৫ বছরের অধিক হতে হবে। কি অদ্ভুত নিয়ম! বস্তুত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত বেশির ভাগ অর্থাৎ ৯৫ ভাগ ছাত্রদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। তাহলে তারা কিভাবে টিকা পাবে? বর্তমানে গণহারে টিকা দেওয়ার যে গতি তাতে মানে হচ্ছে,লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের টিকা পেতে কম পক্ষে বছর খানেক সময় লেগে যেতে পারে! এছাড়া পর্যাপ্ত টিকার অভাবে বর্তমানে গণটিকা দেওয়া স্থগিত করেছে সরকার। গণটিকা নিয়ে যেখানে আমাদের দেশে এমন বেহাল দশা,সেখানে উন্নত দেশগুলো তাদের দেশের ৮০% লোককে টিকা দেওয়া সম্পণ্ন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অফিস-আদালত,শপিংমল,রেস্তোরা,বিনোদন কেন্দ্র,গণপরিবহন,শিশুপার্ক ইত্যাদি খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সেখানে নির্বিকার।
পড়ুন> লেখকের সব লেখা
সরকারের এহেন আচরণে এসএসসি, এইচএসসি,অনার্স ও মাস্টার্সের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে,ডিপ্রেশনে ভুগে কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে,কেউ কেউ কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি এই হতাশা ও যন্ত্রনাদায়ক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে।বর্তমানে আমরা আক্ষরিক অর্থে এক ধরনের অস্থিরতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে বসবাস করছি। কেউ কারো কথা শুনতে বা বুঝতে চায় না। আর সিনিয়রদেরকে সম্মান করার বিষয়টি তো শিকে উঠেছে।
করোনার পর পরই সরকার সকল শিক্ষার্থীকে পড়াশুনায় ধরে রাখার জন্য অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ এর ঘন ঘন লোডসেডিং ও ইন্টারনের গতি কম হওয়ার কারণে প্রান্তিক এলাকায় অনলাইন ক্লাস তেমন সফল হচ্ছে না। গবেষকদের মতে, ক্লাসরুমে শিক্ষকের সামনে বসে পড়াশোনার যে সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়,অনলাইন ক্লাসে সেটা সম্ভব নয়। এর সাথে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও জড়িত। অনলাইনের ক্লাসের সুযোগে শিক্ষার্থীরা ক্লাস না করে অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মোবাইল বা লেপটপে “ফ্রি ফাইয়ার গেইম” খেলা খেলছে। অনেক জায়গায় এই খেলা নিয়ে জুয়া খেলাও হচ্ছে। কয়েক জায়গায় এই খেলাকে করে খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে। এই ভয়াবহ খেলার প্রতিক্রিয়াস্বরুপ দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই অসামাজিক ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থী বখাটে হয়ে যাচ্ছে। দিনদিনই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এভাবে আরো কিছু চলতে থাকলে জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। ইউনিসেফে এর জড়িপ অনুযায়ী,এ সময় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। দফায় দফায় তা বাড়িয়ে সর্বশেষ এ বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর আজব দেশে আমরা বসবাস করছি! এখানে কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অফিস-আদালত,দোকানপাট, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্র, ব্যাংক, ডাকঘর, কাচাঁবাজার, গণপরিবহন, ট্রেন, লঞ্চ ইত্যাদি খুলে দেওয়া হয়েছে।
কি এক আজগুবি ও অবাস্তব ব্যাপার! সরকারের এ ধরনের দ্বি-মুখী আচরণের কারণে প্রশ্ন আসে-দেশে বসবাসরত অন্যান্য নাগরিকদেরকে বাদ দিয়ে বেছে বেছে করোনাভাইরাস কি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদেরকে আক্রমন করবে বা কেবলমাত্র শিক্ষার্থীরাই এই ভয়াবহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বা আক্রান্ত হবেন? অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িত আমাদের দেশের প্রায় দুই কোটি লোক বেকার হবেন। আর এই দুই কোটি লোকের একটি বড় অংশ হলো বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষক।
মানুষ গড়ার কারিগরা আজ বেকারত্বে অভিশাপ নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জীবিকার প্রয়োজনে তারা আজ ফুটপাতে চা বিক্রি করছেন,সবজি বিক্রি করছেন। এমনকি অনেকে হকারী বা পরিচ্ছণ্নতাকর্মীর কাজ করতেও বাধ্য হচ্ছে। এটা আমাদের জাতির জন্য ভিষণ লজ্জার ব্যাপার! এই গ্লানি বা দুঃখ আমার রাখব কোথায়?
মূলত শিক্ষাই একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষা ব্যক্তির চিন্তা ও আচরণ মার্জিত ও পরিশীলিত করে। যে জাতির চিন্তা-চেতনা যতো বেশি মার্জিত ও পরিশীলিত, সে জাতি ততো উন্নত। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠাকে বা ভাবিষ্যতের সুনাগরিকদেরকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে শুধু কলকারখান,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা দেশের সার্বিক উন্নয়ন মোটেই সম্ভব নয়। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালগুলো খোলা উচিত। অতঃপর কলেজগুলো খোলা দরকার। কারণ বিশ্ববিদ্যাল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। তারপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রথমে মাধ্যমিক ও সর্বশেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামাজিক দূরত্ব অটুট রেখে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে।
আমাদের জন্য খুশীর খবর হলো-স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে,দেশে চলিত বছরের ১ আগস্ট থেকে করোনার সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। এর আগের দিন অথার্ৎ ৩১ জুলাই পরীক্ষা অনুপাতে রোগীর শানক্তের হার ছিলো ৩০ দশমিক ২৪ শতাংশ। পরের দিন তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৯৭শতাংশ। এরপর থেকেই দৈনিক শনাক্ত এর হার কমতে থাকে। সর্বশেষ ১৯ দিন পর গত ২৪ ঘণ্টায় (১৮ আগস্ট পর্যন্ত) এই হার আরও কমে ১৭ দশমিক ৬৭শতাংশে নেমে আসে। অথার্ৎ গত ১৯ দিনে সংক্রমণের হার ১৩ শতাংশ কমেছে। সংক্রমণের হার এ হারে কমতে থাকলে এ মাসের শেষে তা ৫ শতাংশের নিচে এসে দাঁড়াবে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিতপ্তরের গবেষকরা। সুতরাং সংক্রমণের এ হার অব্যাহত থাকলে বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার তথ্য,সংজ্ঞা ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আমাদের দেশের সবকিছু খুলে দেওয়া সম্ভব।
অতএব আশা করা যায়, সরকার শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলিত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পর্যায়ক্রমে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘোষনাপত্র জারি করবে। পাশাপাশি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে টিকার আওতায় আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
খায়রুল আকরাম খান: সাংবাদিক, কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: চিন্তা, নাগরিক সাংবাদিকতা, নিয়ম-কানুন
[sharethis-inline-buttons]