শুক্রবার রাত ৯:৩৬, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

পতাকায় মোড়ানো এ দেশ কি আমার?

জুনায়েদ গালিব

এক. যে মুহুর্তে আমি ভি.আই.পি হয়ে আমার প্রাপ্য সেবাটি আদায় করে নিলাম, মনে মনে আমি হেরে গেলাম। আমি আর নির্ভয়, সৎ নাগরিক রইলাম না। দুই. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে গেলেই দেখবেন আপনাকে আইন দেখানো হচ্ছে, নিয়ম দেখানো হচ্ছে। কিন্তু, ন্যায়বিচার কেউ দেখাবে না। সামাজিক ন্যায়বিচার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে কেউ কাজ করে না। ন্যায়বিচারকে তথাকথিত আইনের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়েছে।

‘সরকারী অফিসে’ সেদিন সেবা নিতে গিয়ে বেশ অভিজ্ঞতা হল। এরপর থেকেই ভাবছি বিষয়টি নিয়ে লিখব। হাতটা নিশপিশ করছিল। কিন্তু বেশ কয়েকঘণ্টা ধৈর্য ধরে ভাবলাম, বেশিমাত্রায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক লেখালেখি করে তৃপ্তি পাওয়া যাবে না। এর সাথে রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বিষয়সমূহ জড়িত। তাই সেই অভিজ্ঞতার কিছুটা ভুমিকা দিয়েই শুরু করতে চাই।

সকাল সাড়ে দশটায় গিয়েছিলাম মালিবাগ এস.বি অফিসে, পাসপোর্ট নিতে। তাদের কাছ থেকে সেবা নিতে শুরু করেছি নিঃসংকোচ, নির্ভয় ও নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার হিসেবে। কিন্তু এর মাঝে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যেতে যেতে, অপেক্ষা করতে করতে কী যে হল। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে আমার মুখের হাসি মিইয়ে যেতে লাগলো। দেশের নাগরিক হিসেবে যে নির্ভয় গর্বিত শক্তি ছিলো তা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অনবরত পুলিশের কর্তা হতে কেরানি পর্যন্ত নির্বিচারে সবার তাচ্ছিল্য, ঔদ্ধত্য আর অহমিকায় আমিও বদলে যেতে লাগলাম। সাধারণ, নির্ভয়, সৎ নাগরিক থেকে আমাকে হয়ে যেতে হল অসৎ, কঠোর ও ভি.আই.পি এক লোক।

এতে লাঞ্চের পরই বদলে গেল দৃশ্যপট! অন্য সব সিরিয়াল টপকে আমাকে পরম যত্নে নিয়ে গিয়ে, ভালোমতো ব্যাখ্যা-অজুহাত দিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে দেয়া হল। পাসপোর্ট পেয়েছি বিকাল সাড়ে চারটায়। বাধ্য হয়ে করেছি এই কাজটি। না করলে আমার আর পাসপোর্ট নিয়ে যথাসময়ে আমেরিকা ফেরত যাওয়া হতো না। পাঠক, আমার কোনো অপরাধের কারণে পাসপোর্ট তাদের কাছে যায়নি এমন নয়। অতএব আমার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ ছিলো না। কিন্তু যে মুহুর্তে আমি ভি.আই.পি হয়ে আমার প্রাপ্য সেবাটি আদায় করে নিলাম, মনে মনে আমি হেরে গেলাম। আমি আর নির্ভয়, সৎ নাগরিক রইলাম না। পড়ন্ত বিকেলে “এ দেশ আমার। এখানে নাগরিক অধিকার আমার প্রাপ্য। জোর-জবরদস্তি, সুপারিশের কি প্রয়োজন?”- এইসব ভাবাবেগ উবে গেলো।

সেবাদানকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে গালাগাল করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। অপেশাদার, অমানুষ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অসৎ ভি.আই.পি নাগরিকদের অনাচার-অন্যায় এর কারণে সংক্ষুব্ধ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি কেউ শখের বশে গালাগাল করে না। অবিচার এবং অন্যায়ের ভুক্তভোগী হয়ে তার পরেই করে- এটা রাষ্ট্রকে গালাগাল করার শামিল। কবি যেভাবে মানচিত্র চিবিয়ে খাওয়ার কথা বলেছিলেন, পূর্নিমার চাঁদ যেভাবে ঝলসানো রুটি হয়ে যায়, ঠিক সেই ভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অবিচারের শিকার হয়ে নাগরিকের কাছে দেশপ্রেম, ‘এ দেশ আমার’, ‘দেশটা কি মা না?’ এ জাতীয় ভাবাবেগ লাথির যোগ্য আতলামি হয়ে যায়। কোনো মা তার সন্তানের প্রতি এইভাবে দিনের পর দিন অবিচার-অন্যায় চালিয়ে যেতে পারেন না। এই ঘুণে ধরা রাষ্ট্রকে মায়ের মতো পবিত্রতার সাথে তুলনা করা ভণ্ডামী ছাড়া আর কিছুই না। মা যেভাবে সন্তানদের আগলে রাখেন, সেভাবে আগে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক- তারপর দেশকে ‘মা’ এর পবিত্রতার সাথে তুলনা করা যাবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে গেলেই দেখবেন আপনাকে আইন দেখানো হচ্ছে, নিয়ম দেখানো হচ্ছে। কিন্তু, ন্যায়বিচার কেউ দেখাবে না। সামাজিক ন্যায়বিচার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে কেউ কাজ করে না। ন্যায়বিচারকে তথাকথিত আইনের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়েছে। অথচ ন্যায়বিচার না হলে সেই আইনের নৈতিকতাই হয়ে যায় প্রশ্নবিদ্ধ! এ কারণে মনুষত্বও আইনের শর্তসাপেক্ষ বিষয় হয়ে গিয়েছে। মনুষ্যত্ব আইনের অধিনস্থ হয়ে গিয়েছে। জানি না কোনোদিন হবে কিনা; তবে আইনের শাসন (Rule of Law)-এর পরিবর্তে ন্যায়বিচারের শাসন (Rule of Justice) হলে আমার মতে ভালো হবে। বিচার-বিভাগের মধ্যে নাগরিকদের যে পর্যুদস্ত অবস্থা, তা আমি দেখেছি। উকিলের মেধা নয়, নাগরিকের হক্ব নয়, বিচার হয় টাকা আর প্রভাব এর হিসেব-নিকেশে। মেজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে বিচারপতিরা পর্যন্ত ঘুষ খেয়ে এবং অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হয়ে রায় দেন।

সমস্যার ফিরিস্তি দিলে শেষ হবে না। কিন্তু সমস্যা তালাবন্ধ করে একটা বাক্সে বন্দী করে, জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে রেখে, সেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে “জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” ইত্যাদি স্লোগানে লাগাতার গা ভাসালেই সেটাকে দেশপ্রেম বলা যাবে না। সেটা হয়ে যাবে উত্তর কোরিয়ার মতো শক্ত কম্যুনিজম। সেটা বাংলাদেশের মানুষ চায় না। সমস্যার বাক্স অন্যান্য দেশেরও আছে। কার সমস্যা কত বেশি এই ঘাটাঘাটি করতে করতে আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলি পঁচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এতটা সময় বরঞ্চ জন-উন্নয়ন তথা আত্মোন্নয়নে কাজ করলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে। আশাকরি পরের লেখাটা আত্মোন্নয়ন নিয়ে লিখতে পারবো।

জুনায়েদ আব্দুল্লাহ গালিব : প্রবাসী, যুক্তরাষ্ট্র

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply