“বিজ্ঞানের স্রোতে ভেসে চলা মানুষগুলো বিজ্ঞানের জ্ঞানকে এমনভাবে আকড়ে ধরেছে, যেন বিজ্ঞানই তার সকল চাওয়া-পাওয়া মিটিয়ে দেবে। অথচ বিজ্ঞান দিন দিন প্রকৃত জ্ঞানকে বাদ দিয়ে শুধু প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”
অসীম চাহিদার ভাণ্ডার মানুষ। একটি চাহিদা পূরণ হতে না হতেই আরেকটি চাহিদা জন্ম নেয়। এসব চাহিদা পূরণ করার জন্য যত রকমের কৌশল-অপকৌশল রয়েছে, তা সে প্রয়োগ করে যায় নিরলসভাবে। একটুও ক্লান্তি দেখা যায় না তার মাঝে, আপাতত প্রয়োজনটা মেটাতে। সে ভেবে দেখার জন্য গতিশীল জীবনকে স্থির করতে চায় না একটু সময়ের জন্য। অথচ কিছু প্রয়োজনীয়তা এমন যে একটা মানুষের জীবন ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। যা সে ফলাফলের সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত বুঝত পারে না। সব কিছুই সবার প্রয়োজন নেই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য। স্থান, কালভেদে একেজনের চাহিদা একেক রকম হয় ঠিকই, কিন্তু মৌলিক চাহিদা সকল মানুষের এক। যারা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো নির্ধারণে ব্যর্থ হয়, তারাই ঘুরে বেড়ায় প্রাসঙ্গিক চাহিদাগুলো একের পর এক পূরণে। তখন একশ্রেণির শক্তিশালী লোকও তৈরি হয়ে যায়, এদের প্রাসঙ্গিক চাহিদাগুলোকে ‘অতি প্রয়্জেনীয়’ এবং সহজলভ্য করার জন্য।
বিজ্ঞানের স্রোতে ভেসে চলা মানুষগুলো বিজ্ঞানের জ্ঞানকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে, যেন বিজ্ঞানই তার সকল চাওয়া-পাওয়া মিটিয়ে দেবে। অথচ বিজ্ঞান দিন দিন প্রকৃত জ্ঞানকে বাদ দিয়ে শুধু প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষগুলোও দিন দিন প্রযুক্তিকে আকড়ে ধরে জ্বলজ্যান্ত একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। তবে কী প্রযুক্তি উদ্ভাবন বন্ধ করতে হবে? না, সে কথা বলছি না। বলতে চাই, মানবিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানের মাঝে দুরত্ব কমিয়ে একটা ভারসামপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কথা।
আরো পড়ুন> অপরিণামদর্শী বিয়ে, আস্থার সংকট ও তালাক
প্রযুক্তিকে আকড়ে ধরে গড়ে উঠেছে একশ্রেণির শোষক। যারা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞান সাধনায় নিযুক্ত মানুষগুলোকে অর্থকেন্দ্রিক ভাবনায় ভাবিয়ে তুলছে। তারা আজ হয়ে পড়েছে নিজেরাই একেকটা যন্ত্রমানবে। নেই কোনো গঠনমূলক তাত্ত্বিকতা, নেই কোনো মানবতার ছোঁয়া। আছে শুধু কী করে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ও ক্ষমতাশীল হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা যায়! কারণ শোষক শ্রেণির বড় বড় শোষকরা আজ তাদের রোল অব মডেল। তারা মানুষের চাহিদামাফিক পণ্য দিয়ে মানুষকে কাবু করে রাখে। অন্যদিকে বিজ্ঞান সাধকরা তো আর মানুষের বাহিরে নয়। তাই তাদেরকে তাদের চাহিদামাফিক প্রাপত্যা দিয়ে সন্তুষ্ট রেখে নিজেদের শোষণের অস্ত্রগুলোকে দিন কি দিন উন্নত করে চলছে। একটি সমাজ বা জাতিকে ধ্বংস করার প্রধান উপায় হলো তার প্রয়োজনীয়তাগুলো সহজভাবে পূরণ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
“প্রযুক্তিকে আকড়ে ধরে গড়ে উঠেছে একশ্রেণির শোষক। যারা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞান সাধনায় নিযুক্ত মানুষগুলোকে অর্থকেন্দ্রিক ভাবনায় ভাবিয়ে তুলছে। তারা আজ হয়ে পড়েছে নিজেরাই একেকটা যন্ত্রমানবে। নেই কোনো গঠনমূলক তাত্ত্বিকতা, নেই কোনো মানবতার ছোঁয়া। আছে শুধু কী করে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ও ক্ষমতাশীল হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা যায়!”
প্রযুক্তির যাতাকলে পরে আজ মানুষ তার সম্পূর্ণ সত্তাটাকে হারিয়ে ফেলছে। যা এখন সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না। কেউ তাকে এ বিষয়ে বললে তার কাছে ঐশ্বরিক বাণীর মতো মনে হয়। আসলে যখন মানুষ তার নিজের অস্তিত্বটাকে হারিয়ে ফেলে, তখন সে যতই উন্নত চিন্ত-ভাবনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান আকড়ে ধরুক না কেন, তার ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবে না। তখন সে শুধু বর্তমানটাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। আর বাকি সবকিছু তার কাছে মিথ্যে না হয় স্বপ্নের মতো লাগতে শুরু করে।
লেখকের সব কলাম
আধুনিক কালটা বিজ্ঞানের, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিজ্ঞান তার উন্নতির দ্বারা আমদের জটিল জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলেছে ঠিকই। কিন্তু বিজ্ঞান যতই সহজ করতে চাক না কেন, জীবন আসলে তত সহজ নয়! যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, পণ্য উপৎপাদন ব্যবস্থা তাদের আয়ত্বের ভেতরে। এগুলো দিয়েই কী মানুষ তার পূর্নতা লাভ করতে পারে? আসলে যারা এমনটা ভাবছেন যে এগুলোই মানুষের পূর্ণতার একমাত্র ধারক, দোষটা তাদেরই। বাস্তবতা আমাদের এ সত্য উপলব্ধি করায় হাড়ে হাড়ে। বিজ্ঞান শুধু তার উন্নত ব্যবস্থা দিয়ে মানুষের কিছু জটিল কাজকে সহজ করতে পারে, যা মানুষকে মানুষ হিসেবে পুণর্গঠনে সামান্য সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
“বিজ্ঞান সাধকরা তো আর মানুষের বাহিরে নয়। তাই তাদেরকে তাদের চাহিদামাফিক প্রাপত্যা দিয়ে সন্তুষ্ট রেখে নিজেদের শোষণের অস্ত্রগুলোকে দিন কি দিন উন্নত করে চলছে। একটি সমাজ বা জাতিকে ধ্বংস করার প্রধান উপায় হলো তার প্রয়োজনীয়তাগুলো সহজভাবে পূরণ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া।”
বিজ্ঞান নির্ভর এ সমাজে কোনো কিছুকে কঠিন হিসেবে মেনে নিতে মানুষ নারাজ। অথচ মানুষের বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য হলো সে যখন কোনোকিছু সহজে পেয়ে যায়, তার যথাযোগ্য মূল্য বা মর্যাদা কোনাটাই দিতে পারে না সে। জীবনে যারা খুব কষ্ট করে জীবনকে উপলব্ধি করে তারাই পৃথিবীর কল্যাণের জন্য কিছু একটা রেখে যেতে পারে। বিজ্ঞানের কাজ ছিলো, জ্ঞান ও রহস্যকে উন্মোচন করে মানুষের বিভ্রান্ত বিশ্বাসগুলোকে দূর করে তাদের মাঝে সত্য আর শৃঙ্খলার এক অভঙ্গুর বন্ধন তৈরি করা। তা না করে আজ তারা শুধু প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করছে নিজেদের মহামূল্যবান সময় ও মেধা।
প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে মানুষ হয়তোবা হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম থেকে বেঁচে শারীরিক সুখ কিছুটা অনুভব করে। কিন্তু বিজ্ঞান তাকে মানসিক পরিশ্রম হতে মুক্ত করে কতটুকু মানসিক মুক্তি ও শান্তি দিতে এনে দিতে পেরেছে? বিজ্ঞানমনস্ক মানুষগুলো বুলি আউড়ে বেড়ায়, মানুষের জীবনের একমাত্র মুক্তি এনে দিতে পারে যথার্থ বিজ্ঞান সাধনা।
অতীতে বিজ্ঞান সাধনায় যারা মগ্ন ছিলেন তাদের জীবনযাপন, সামাজিক অবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, এগুলো তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ কোনো মানুষই শত চেষ্টা করে এগুলোকে অতিক্রম করতে পারে না। কারণ মানুষ নিজের অজান্তে এক সমন্বিত সৃষ্টি। তাই সে নিজেকে কখনো বিছিন্নভাবে কল্পনা করতে পারে না। বিজ্ঞান মানুষকে শারীরিক একটা সুখ দিতে পারে, কিন্তু এই শারীরিক সুখ যে খুব বেশি একট স্থায়ী নয় মানুষের এই অসীম চাহিদাসম্পন্ন ক্ষণস্থায়ী জীবনে?
শরীফ উদ্দীন রনি : শিক্ষক, কলামিস্ট
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]