আমার বউ খাদিজা চমকে ওঠার মতো সুন্দরী। আমার লেখার প্রেমে পড়বার পর সাতপাকে বাঁধা পড়তে সে তিন মাসের বেশি সময় নেয়নি। বিয়ে করার পর উপলব্ধি করলাম খাদিজা শিল্প সাহিত্য ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। একজন লেখকের জীবনকে দূর থেকে দেখে যতোটা আকর্ষণীয় মনে হয়, বাস্তবে তার ঠিক বিপরীত। সারারাত কম্পিউটার টেবিলে সামনে একটু কুঁজো হয়ে বসে থাকি। এই বিষয়টা উপলব্ধি করে খাদিজা ভেঙে পড়লো। আমি লেখালেখি করি বলে সে বিরক্ত হয়ে থাকে। লেখার সাথে বাস্তবের আমির বিস্তর ফারাক। গম্ভীর, চুপচাপ মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। একদিন রাতে শুনলাম খাদিজা তার মাকে ফোন করে বলছে, শেষকালে কপালে জুটলো একটা ভ্যাবলা জামাই। সারারাত কম্পিউটার টেবিলে বসে কি যেন লেখে! আমার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাইঙ্গা যাইতেছে মা।
প্রতিদিন রাত বারোটার পর লিখতে বসি।যতটুকু সময় কম্পিউটার টেবিলে বসে লিখি ততক্ষণই এয়ার ফোন কানে লাগিয়ে গান শুনি। টানা চার পাঁচ ঘণ্টা লিখে যাই। খাদিজা ঘুম থেকে উঠে ঋষির মতো মগ্ন হয়ে লিখতে থাকা আমার দিকে ল্যাপটপের নষ্ট ব্যাটারির মতো তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়ে থাকে।মাঝ রাতে প্রায়ই আমি ইউকুলেলে বাজিয়ে জীবনমুখী গান ধরি। ও বিরক্তির ভান মুখে এনে গানগুলো শোনে ।
খাদিজা প্রায়ই আমার সাথে ঠিক করে কথা বলে না। আমরা ইশারা ইঙ্গিতে কাজ চালিয়ে নেয়।ঘুমিয়ে যাবার পর খাদিজার নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকায়া থাকি আউলা দৃষ্টিতে। গভীর রাতগুলো ওর নিখুঁত গভীর নাভিটাকে নিজের লেখা কোন ছোটগল্পের সাথে মেলাই। সহজিয়া সাদামাটা সুখগুলোতে বুঁদ হয়ে যেতে নিতান্তই মন্দ লাগে না।
খাদিজা আমাকে ম্যানা গরু বলতো। খাদিজা রেগে উঠলে সে সাহিত্যের মানুষদের বলে বহুগামী লুচ্চা বদমাশের গুষ্টি।সে আমাকে ভৎসনা করে ইতর,বহুগামী, লুচ্চা-বদমাশ সেই ভাষায়। শুনে আমার শ্বাসকষ্টের মতো হয়।এই কঠিন শব্দগুলো বারবার শুনি। নীরবে সহ্য করে যাই। সাহিত্যের প্রতি এই মানসিকতা বুকে ধারণ করে চলা নারীর সাথে আমি এক বিছানায় ঘুমাই। দিব্বি রুটিন মেনে সংসার করি।রুচিতে কি ভীষণরকম অমিল থাকবার পরও আমি আর খাদিজা বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে কাটিয়ে দিচ্ছি।
অসুখী খাদিজার চাঁছাছোলা বাক্যে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয়েও তাই বেশ আছি।মাঝে মাঝে বাপ হওয়ার জন্যও মন আঁকুপাঁকু করে। সন্তান নেবার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলো সে।সে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলো না নিষ্পাপ একটা প্রাণকে অভ্যর্থনা জানিয়ে পৃথিবীতে আনবার জন্য।
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বলে ঘন ঘন লোডশেডিং হতো। তীব্র গরমের মাঝে জেদ করে জামাকাপড় খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসে থাকতো খাদিজা। আমি তাকে জামাকাপড় পরাৱ জন্য নরম গলায় অনুরোধ করলে দাঁত কিড়মিড় করতো জেদে। মোমবাতির আলোয় রাগে লাল হয়ে থাকা সুন্দর মুখটা দেখে আমার মায়া লাগতো। কেন যেন সেই মুহূর্তে চোখ মেলে তার সুন্দর শরীরটার দিকে তাকাতে পারতাম না।এক রাতে মিলনের সময় কি এক ভালো লাগায় আমার চুলের মুঠি ধরে টলাটলা চোখে সে বলে ওঠে, আমি তোমাকে তীব্রভাবে ঘেন্না করি খ্যাপাটে লেখক! যদি সুযোগ থাকতো, সে নাকি আমার চুলের মুঠি ধরে জবাই করত।
আমি শুনে স্পষ্টভাবে তার চোখের দিকে তাকাই। বোঝার চেষ্টা করি, ভালোবাসা না থাকার পরও কারো প্রতি একটা মানুষের এতো প্রেমঘেঁষা ঈর্ষা কি করে কাজ করে! বউটা হুঁশে নেই। দুখী মানুষদের বেহুঁশ বেহিসেবী কথাবার্তা ধরতে নেই কখনো। আমি ছাড়া এখন ওর কেই বা আছে! হয়তো গভীরভাবে সে আমাকে ভালোবাসে না, কিন্তু এক বিছানায় তো ঘুমায়। বেখেয়ালে আমার বুকে চুমু খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেটাই বা কম কি? গভীর রাতে দেয়ালে টাঙ্গানো বিয়ের লাল বেনারসি পরা ওর ছবিটা দেখি৷
শব্দ নিয়ে খেলার বিলাসিতায় আর মন সায় দেয় না। তার থেকে রান্নাঘরে বউয়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে ভাতের চাল ধোয়ার পানি ফেলে দিলে সংসারে সুখও সাচ্ছন্দ আসবে । আমার খুব ইচ্ছা করতেছে খাদিজাকে নিয়ে শহরের যান্ত্রিক, অপবিত্র জীবন ছেড়ে গ্রামে চলে যাই। কিন্তু গ্রামগুলোও আর আগের মতো নাই। সেখানকার মানুষগুলো শহুরে হয়ে উঠবার প্রাণপণ চেষ্টায় আছে। জগাখিচুড়ি এক সংস্কৃতি বানিয়ে নিজদেরকে জাদুঘরে রাখার মায়াবী আবেদন তৈরি করছে ক্রমশ। গভীর ঘুমে থাকা খাদিজার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। অসময়ের ঝুম বৃষ্টিতে আকাশে জমতে থাকা এতো সময়ের গ্লানিময় মেঘ কেটে যাচ্ছে ধীরে।
Some text
ক্যাটাগরি: গল্প
[sharethis-inline-buttons]