শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটি শ্রেণিতে যে পাঠ্যক্রম অধ্যায়ন করতে হয়, তা কি কোমলতি শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক বা বিবেকের আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে? প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিবেক বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। জাগ্রত হচ্ছে দুর্নীতিপরায়নতা, বিভেদ, বৈষম্য, প্রতিহিংসা। তবুও কী আমরা বলব আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্মত ও মানবিক?
শিক্ষা হচ্ছে একজন মানুষের সার্বিক দক্ষতা ও সামগ্রিক উন্নয়ন, যা অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী হবে। শিক্ষা মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও জীবনের সামগ্রিক প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রশিক্ষণ হচ্ছে- পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন, যা স্বল্পমেয়াদী। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসম্পাদন ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষায় ঝরে পড়া বা নিরূৎসাহী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারিগরি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। আর কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারিক ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে।
মানবশিশু জন্মগ্রহণের দুচার বছর পর সাধারণ শিক্ষায় হাতে খড়ি হয়। শিক্ষাজীবনে একজন শিক্ষার্থীর প্রথমেই প্রাথমিক বিদ্যালয় অথবা কিন্ডার গার্টেনের সাথে পরিচিতি ঘটে। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটি শ্রেণিতে যে পাঠ্যক্রম অধ্যায়ন করতে হয়, তা কি কোমলতি শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক বা বিবেকের আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে? মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অথবা ডিগ্রি অর্জন করার পর যদি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সততা ও মানবিকতা থাকত তবে এদেশে দুর্নীতি এবং মানুষের মাঝে প্রতিহিংসা, বিভেদ, বৈষম্য ইত্যাদি দেখা যেত না। উচ্চশিক্ষার উচ্চপদের ব্যক্তিরা যদি সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত থাকত তবে নিচের পর্যায়ের ব্যক্তিরা দুর্নীতি করার সাহস পেত না। তার মানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিবেক বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। জাগ্রত হচ্ছে দুর্নীতিপরায়নতা, বিভেদ, বৈষম্য, প্রতিহিংসা। তবুও কী আমরা বলব আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্মত ও মানবিক?
একজন শিশু যখন বাবা-মার হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা শুরু করে, তখন থেকেই তার সাথে স্কুল-কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের শুরু হয় ব্যবসা। এ ব্যবসা শুধুই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত তা নয়, বই-খাতা, ইউনিফর্ম, জুতা, বেল্ট ইত্যাদি নিয়েও চলতে থাকে জমজমাট ব্যবসা। শিক্ষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত শিক্ষার জন্য ছোট্ট শিশুটিকে ছুটে যেতে হয় প্রাইভেটে। শিক্ষা জীবনে ভর্তিযুদ্ধ, ভর্তি-বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস- কত কিছুর সাথে পরিচিত হতে হয়! বারোটি বছর পড়াশুনা করার পর ছুটে যেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। এর জন্য গুণতে হয় বিশাল পরিমাণের টাকা। বারো বছরের শিক্ষকের শিক্ষা কী তাকে মাত্র একটি ভর্তিযুদ্ধের জন্য গড়ে তুলেছে? জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে হলে এই শিক্ষা কীভাবে তাকে সাহায্য করবে?
পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষার্থীর জ্ঞান যেমন থাকে সীমাবদ্ধ, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবেশ তাকে করে বিপথগামী ও জ্ঞানান্ধ। সাধারণ শিক্ষায় অনাগ্রহী ও অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু যে শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রম জটিল মনে করে কারিগরি বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে ভর্তি হয়, সে শিক্ষার্থীদেরও সাধারণ শিক্ষার বিষয়সমূহ অধ্যয়ন করতে হয় এবং সেই সাথে কারিগরি প্রক্ষিণের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়ও তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এতে তাকে সাধারণ বিষয়ের পড়ালেখায়ও গুরুত্ব দিতে হয়, যে কারণে কারিগরি বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না। ফলে তার উদ্দেশ্যও সফল হয়না, দক্ষতার বিকাশ ঘটে না। যারা সাধারণ শিক্ষা ত্যাগ করে শুধু কারিগরি প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে আসে, তাদের শিক্ষাও সার্থক হয় না। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও অনভিজ্ঞতা, সংশ্লিষ্ট কাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মালামালের অপর্যাপ্ততা, সাধারণ শিক্ষার বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা কারিগরি শিক্ষা পরিচালনা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে আছে।
কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য কাঁচামাল ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেশিন ক্রয়ের জন্য বেশি পরিমাণ ব্যয় করতে হয়। প্রশিক্ষকরা বিপুল বাজেটের মালামাল ক্রয় করতে গিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। তাদের প্রশিক্ষণার্থীদের দিকে নজর দেয়ার সুয়োগ হয় না । ঢাকার ধোলাই খালে সনদপত্র বিহীন একজন মেকানিকের দক্ষতা আর কারিগরি প্রশিক্ষণের সনদ অর্জনকারি মেকানিকের দক্ষতার অনেক ব্যবধান। কারিগরি শিক্ষাও আজকাল সনদপত্র নির্ভর হয়ে পড়ায়, শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের চেয়ে সনদ পাওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে বেশি। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মত কারিগরি শিক্ষায় দূর্নীতি ও অব্যস্থাপনা বিরাজমান থাকায় কাক্সিক্ষত সুফল অর্জন হচ্ছে না। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ও আছে বিতর্ক ও মতভেদ। এর পাঠ্যক্রম বিভিন্ন সময় পরিবর্তন এবং সুদৃষ্টির অভাবে এ শিক্ষা কাঠামো আশানুরূপ হচ্ছেনা। এ দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থী তবে কোন শিক্ষাব্যবস্থায় আশ্রয় নেবে?
লেখক : এ. বি. এম. ফয়েজুর রহমান
সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি)
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, শিক্ষা-গণমাধ্যম, সম্পাদকের বাছাই
[sharethis-inline-buttons]
সমাধানের কোন উপায় দেয়া হয়নি।
যদিও ব্যাপারটি খুব কঠিন। বৃটিশ শাসন আমল থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে কোনোটিই জ্ঞানভিত্তিক ও গণমুখী শিক্ষা নয়। সাম্রাজ্যবাদ কখনো চায় না, আমাদের দেশে জ্ঞানভিত্তিক ও গণমুখী শিক্ষা চালু হোক। সুতরাং ‘জ্ঞানভিত্তিক ও গণমুখী শিক্ষা’ চালু করতে হলে আপনাকে আমাকেই প্রথমে সংশোধন হতে হবে। তারপর আমরাই তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সংজ্ঞা দেয়া আছে।
শিক্ষার সংজ্ঞা প্রদান করলে লেখাটা আরো ভালো হতো। যে জাতি শিক্ষার সংজ্ঞাই বোঝে না তাদের আবার শিক্ষাব্যবস্থা।
“শিক্ষা হচ্ছে একজন মানুষের সার্বিক দক্ষতা ও সামগ্রিক উন্নয়ন, যা অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী হবে। শিক্ষা মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও জীবনের সামগ্রিক প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রশিক্ষণ হচ্ছে- পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন, যা স্বল্পমেয়াদী। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসম্পাদন ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষায় ঝরে পড়া বা নিরূৎসাহী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারিগরি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। আর কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারিক ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে।”
এখানে শিক্ষার মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার সঙ্গে ‘প্রশিক্ষণ’ ও ‘কারিগরি শিক্ষার’ পার্থক্য এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্দেশ করা হয়েছে। ধন্যবাদ লেখককে।
তবে এতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং শুরু হয়। যারা সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে, তাদেরই দায়িত্ব বাস্তবে সমাধানের প্রয়াস চালানো।