শনিবার বিকাল ৪:২৭, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও আমরা

মোজাম্মেল হক

দীর্ঘ ২৪ বছর নিভৃত জীবন যাপন করে তিনি জানিয়ে গেলেন, আত্মস্বার্থ বা পারিবারিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি বা ভোগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান নয়। মাটির মমতায়, স্বজাতি ও জন্মভূমির কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যেই তিনি স্বাধীনতার মহান যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

প্রয়াত হয়ে গেলেন বীর প্রতীক তারামন বিবি। দু’জন নারী বীর প্রতীক-এর একজন তিনি। মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে কাজের মেয়ে হিসেবে যোগ দিয়ে স্বীয় যোগ্যতায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে যিনি নিজেকে বীর যোদ্ধায় রূপান্তরিত ও উন্নীত করেন। যোগদানের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল। প্রমাণ করেছেন তিনি স্বজাতি ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকলে বয়স কোনো বাধা হতে পারে না। দেশের টানে এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো সাধারণ জনগণ। লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী পাকিস্তানী বর্বর সেনাদের পৈশাচিক নিপীড়ণ নির্যাতনের, জিঘাংসার, ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল। এঁদেরই রক্তে স্নাত আমাদের জননী, জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমরা কি তাঁদের সেইভাবে স্মরণ করি? যথাযথ মল্যায়ন করি? সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকি? আমাদের সন্তানদের নিকট তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরি? কোনো জাতি যখন তার বীর সন্তানদের বিস্মৃত হয়, ঐ জাতিতে তখন আর বীর সন্তান জন্ম নেয় না।

তারামন বিবি মাত্র বাষট্টি বছর বেঁচেছিলেন। মুক্তি সেনাদের ফাই ফরমাশ খেটেছেন, রান্নাবান্না করেছেন, সংবাদ আদান প্রদান করেছেন, অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। অথচ এ-রকম এক অকুতোভয় নারী মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে পদক গ্রহণ করে কুড়িগ্রামের নিভৃত এক পল্লীতে ২৪ বছর কাটিয়ে দিলেন। আনন্দ মোহন কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বিমল কান্তি দে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশে তথায় গমন করলে সেখানে তিনি তারামন বিবি ও তাঁর পরিবারের সন্ধান পেয়ে যান। অর্থাৎ অধ্যাপক সাহেবের অনুসন্ধানেই তাঁর নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফলশ্রুতিতে সরকার তাঁর ও তাঁর পরিবারের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ডায়াবেটিক, শ্বাসকষ্টসহ বিভন্ন অসুস্থতা থাকলেও জীবনের বাদবাকীা বছরগুলো সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গেই কাটিয়েছেন তিনি। আমরা কি এখনো জানি বা খোঁজ নেই অতীতে এভাবে অনাদরে অবহেলায় আরো কত মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পথযাত্রি হয়েছেন?

দীর্ঘ ২৪ বছর নিভৃত জীবন যাপন করে তিনি জানিয়ে গেলেন, আত্মস্বার্থ বা পারিবারিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি বা ভোগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান নয়। মাটির মমতায়, স্বজাতি ও জন্মভূমির কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যেই তিনি স্বাধীনতার মহান যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ স্বাধীন দেশে আজ কত মানুষ দেশের জন্য সামান্য কোনো অবদান না রেখেও অবৈধ আয়ের দ্বারা ভিন দেশে অর্থ পাচার করছে, মাদকের কারবার করে যুব সমাজকে ধ্বংস করছে, ব্যাঙ্কের টাকা জালিয়াতি করছে, সন্তানদের ভিনদেশে পড়াচ্ছে, ধিক্কার ও নিন্দা জানাই তাদের।

বীর প্রতীক তারামন বিবি দেশপ্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। দেশের প্রতি তিনি তাঁর দায় কড়ায় গণ্ডায় শোধ করেছেন, নিয়েছেন অল্প, দিয়েছেন অনেক। আমরা তাঁর নিকট ঋণী, দেশ মাতৃকার এই মহান সন্তানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

ক্যাটাগরি: মিনি কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply