সোমবার সকাল ১১:৩০, ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

প্রত্যয়ী প্রসঙ্গ (‘দেশ-দর্শন তত্ত্ব’ গ্রন্থের সহ-ভূমিকা)

মহিউদ্দিন আকবর

কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের টেবিলে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না- নিষ্ঠা ও ন্যায়সঙ্গত যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে অস্তিত্ববাদের আলোকিত দর্শনকে। দেশ-জাতি তথা বিশ্বমানবতার কল্যাণে গোটা মানব সম্প্রদায়কে একজাতি এবং একই স্রষ্টার সৃষ্টি জ্ঞানে কল্যাণের পর্দাগুলোকে একে একে উন্মোচনের স্বার্থে কলমী-ইনসাফের বিকল্প কিংবা বিপরীত চেতন থেকে মুখ তো ঘুরাতেই হবে।

ধর্ম-গোত্র-জ্ঞাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের মানবিক সত্তা ও গুণাবলীর ক্রমবিকাশে জ্ঞানাহরণ, অর্জিত জ্ঞানের প্রায়োগিক অধিকারের সীমানা এবং সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার বিষয়ে তত্ত্ব ও দর্শনের আলোকে যতই সাম্যের কথা বলা হোক না কেন, এযাবতকাল ‘কাজীর গরুর’ মতো কেতাবের মাঝেই তার সীমাবদ্ধতা পরিদৃষ্ট। বিশেষত ‘স্খলিত কলমী দুর্জনেরা’ বরাবরই ইনসাফের করিডর ডিঙিয়ে- ‘পরাভব মানি না, মানি না’ বলে চিৎকার করছেন। আর আপন বিবেকের ‘পরাজয়ের ভাবকে’ কৌশলের সম্বল বানিয়ে তাকে নিষ্ঠারসাথে ধ্রুব ভব্যতার সফেদ আঙিনায় প্রতিরোজ হলদেটে আবরণ লেপন করে চলেছেন।

স্বার্থের দাসানুদাসেরা এভাবেই মিথ্যার আড়ালে রেখে ‘পতিত তত্ত্ব-দর্শনকে’ মানবতার মগজ ধোলাইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। বৃন্তচ্যুতির এই মরণ-খেলায় সত্যনিষ্ঠ মানুষেরা বিভ্রান্তির যুপকাষ্ঠে দাঁড়িয়ে রাহু মুক্তির রশি হাতড়ে বেড়ালেও আলো-আঁধারির দোলাচলে পড়ে বারংবার প্রতারিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

সেই সুবাদে সাইক্লোরিমার নেপথ্য ক্রিড়নকেরা অস্তিত্ববাদের মর্মমূলে কুঠারাঘাত হেনে দ্বান্দ্বিকতার মারপ্যাঁচে জড়সভ্যতার চাষাবাদে দৃশ্যমান অবদান রেখে আসছেন। যুগপৎ সত্যকে বিতাড়িত করতে তাদের উর্বর চিন্তা-ভাবনাপ্রসুত বহুবিধ ভ্রান্ত মতবাদের প্রচার প্রসারের বদৌলতে ভোগবাদ, বস্তুবাদ আর জড়বাদের ঘেরাটোপে নাস্তিক্যবাদী দর্শনাবিষ্ট কায়েমি স্বার্থবাদ দিনান্তে দিন মযবুত ভিত রচনা করে চলেছে।

সঙ্গতকারণেই যুগযুগান্তরের জেঁকে থাকা কায়েমি স্বার্থবাদীদের কবল থেকে জাতিকে মুক্তির আলোতে নিয়ে আসার প্রয়াসী বিবেকবানের প্রজ্ঞা ও কৌশলেরসাথে বিবেকহীন কিংবা বিবেক বিক্রেতার প্রজ্ঞা ও কৌশলের তুল্যমূল্য বিচার-বিশ্লেষণের নিক্তিটা ঠাঁঢ় হওয়া আজ বড় প্রয়োজন। অথচ সাপের লেজুড় দিয়ে কান চুলকাতে অভ্যস্ত আয়েশী কূপমণ্ডূকেরা প্রায়শ স্বাপদ ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হলেও সময়ের সে অমোঘ দাবির প্রতি কখনোই ভ্রুক্ষেপ করেননি; করতেও রাজি নন।

স্বার্থের দাসানুদাসেরা এভাবেই মিথ্যার আড়ালে রেখে ‘পতিত তত্ত্ব-দর্শনকে’ মানবতার মগজ ধোলাইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। বৃন্তচ্যুতির এই মরণ-খেলায় সত্যনিষ্ঠ মানুষেরা বিভ্রান্তির যুপকাষ্ঠে দাঁড়িয়ে রাহু মুক্তির রশি হাতড়ে বেড়ালেও আলো-আঁধারির দোলাচলে পড়ে বারংবার প্রতারিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

এই নেতিবাচকতার মর্মমূলে শব্দাঘাত করে অন্ধ-কানাগলি থেকে জ্ঞানপাপীদের আলোকের পথে টেনে আনার প্রয়াস সুদূরপরাহত মরিচিকা বৈ তো নয়। এবংবিধ কারণে, কালের অভিশপ্ত বাদন রোধ করে চিন্তাশীল মানুষের বৃহত্তম ঐক্যের বুনন সংহত করার প্রতি মনোনিবেশের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের টেবিলে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না- নিষ্ঠা ও ন্যায়সঙ্গত যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে অস্তিত্ববাদের আলোকিত দর্শনকে। দেশ-জাতি তথা বিশ্বমানবতার কল্যাণে গোটা মানব সম্প্রদায়কে একজাতি এবং একই স্রষ্টার সৃষ্টি জ্ঞানে কল্যাণের পর্দাগুলোকে একে একে উন্মোচনের স্বার্থে কলমী-ইনসাফের বিকল্প কিংবা বিপরীত চেতন থেকে মুখ তো ঘুরাতেই হবে।

এ কঠিন চ্যালেঞ্জকে ধারণ করে এগিয়ে আসতে প্রথমত আবেগের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেই তবে কৃৎ প্রত্যয়েরসাথে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে। এজন্য সৎসাহস, অবদমিত মনোভাব, অক্লান্ত জ্ঞানসাধন, নির্ভীকচিত্ত এবং অস্তিত্ববাদে অটল-অনঢ় অবস্থান অপরিহার্য। যেখানে আলস্য এবং লোভ-লালসার কোনো স্থান থাকবে না। থাকবে না বিশেষ কোনো দলীয় আনুগত্যেরও দুর্বলতা। যে কলম স্ফূলিঙ্গ হয়ে সতত প্রকাশ করবে সত্যের জ্যোতিস্নাত বস্তুনিষ্ঠ সংলাপ। পাঠক তথা জাতির সামনে থেকে মুছে ফেলতে হবে সত্যের অপলাপ আর মিথ্যার অপচ্ছায়া।

উন্নতশির আত্মপরিচয় অনুসন্ধিৎসু তরুণ চিন্তাবিদ জাকির মাহদিন ‘দেশ-দর্শন তত্ত্ব’ শীর্ষক বক্ষমান গ্রন্থে প্রচলিত বিশ্লেষণের ছকবাঁধা রচনাকৌশলের চারুবাক বদলে দিতে খানিকটা নতুনত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষত গ্রন্থখানির প্রথম অধ্যায়ভুক্ত রচনাবলীতে প্রার্থীত অনুজ্ঞান প্রতিফলন স্পষ্টতই প্রতীয়মান। তিনি এখানে আধুনিক চিন্তা-চেতন থেকে বিচ্যুত না হয়ে একটা পরিচ্ছন্ন মনন ও মানসিকতার প্রতিফলনে ন্যায়নিষ্ঠ আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণের মাঝ দিয়ে সমাজের দুষ্টক্ষতগুলোকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন।

তবে ভুলে গেলে চলবে না, কায়েমি স্বার্থবাদীর কলেরপুতুল অদৃশ্য সূতোর টানে কালো ছায়ার দোলাচলে যে বিভ্রান্তির বেড়াজাল বিছিয়েছে চিরকাল, ছড়িয়েছে কল্পলোকের কুহুক নিনাদ! তার তাল-লয়-সুর-আবহমূর্ছনা আগের থেকে আরও তীব্রতর হবে- রচনা করবে গতিপ্রকৃতির স্রোতচক্রে বহুবিধ বিতর্কিত সংলাপ। কখনও নেমে আসতে পারে প্রতিহিংসার খড়গকৃপাণ। কায়েমি দানবের কৃতদাস তরুণ-তুর্কী কলমবাজ সামনে পেছনে ডানে বামে বহমান সমান্তরাল।

এসব, শত-সহস্র জঞ্জাল অতিক্রম করে আপন মহীমায় দেশ-জাতি-মানবতার কল্যাণে আত্মোৎসর্গী সাহসী কলমসৈনিক, সুসংবদ্ধ অভিমত জাগ্রত রেখে মোকাবেলা করবেন বাধার পাহাড়।

এমনি প্রত্যয়ে উন্নতশির আত্মপরিচয় অনুসন্ধিৎসু তরুণ চিন্তাবিদ জাকির মাহদিন ‘দেশ-দর্শন তত্ত্ব’ শীর্ষক বক্ষমান গ্রন্থে প্রচলিত বিশ্লেষণের ছকবাঁধা রচনাকৌশলের চারুবাক বদলে দিতে খানিকটা নতুনত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষত গ্রন্থখানির প্রথম অধ্যায়ভুক্ত রচনাবলীতে প্রার্থীত অনুজ্ঞান প্রতিফলন স্পষ্টতই প্রতীয়মান। তিনি এখানে আধুনিক চিন্তা-চেতন থেকে বিচ্যুত না হয়ে একটা পরিচ্ছন্ন মনন ও মানসিকতার প্রতিফলনে ন্যায়নিষ্ঠ আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণের মাঝ দিয়ে সমাজের দুষ্টক্ষতগুলোকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। যেখানে একটি সুস্থ দর্শনের সন্ধান মেলে। বিশেষত আলোচনাকালে কোনোরকম আবেগ ও নেতিবাচকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে জনহীতকর পদবাচ্য উচ্চারণে যত্নবান হয়েছেন।

সচেতন পাঠক এখান থেকে পুরোদস্তুর তৃপ্ত হবেন কি হবেন না, সে বিতর্কের অবকাশ না রেখে আমরা বলবো- পাঠক এখান থেকে সন্দেহাতীতভাবে সমাজ-নীরিক্ষার বহুমুখী উপাদান খুঁজে পাবেন। ‘দেশ-দর্শন তত্ত্ব’ চিন্তাশীল দেশপ্রেমী অস্তিত্ববাদী পাঠকমনে নব নব ভাবনার আঁচড় কাটুক সে প্রত্যাশাই করছি।

একইসাথে লেখকের তারুণ্যের প্রতি দৃকপাৎ না করে তার অভিমত এবং দর্শন-তত্ত্বের দিকে মনোনিবেশ করলে পাঠক উপকৃত হবেন- এটা অবলীলায় উচ্চারণ করা যায়। আমরা কায়মনোবাক্যে লেখকের গতিশীল চিন্তাধারার উত্তরোত্তর বিকাশ ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রন্থখানির বহুল প্রচার এবং পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।

মহিউদ্দিন আকবর : নজরুল গবেষক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

উল্লেখ্য : জাকির মাহদিন রচিত দেশ দর্শন তত্ত্ব বইটি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। সহজ ও সাধারণ বাংলা ভাষায় এটি একটি অপরিহার্য চিন্তাধর্মী বই, যেটিকে অনেকে দর্শন-তাত্ত্বিক বলে অভিহিত করছেন। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত দর্শনের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। যা হোক, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও কলাস্টি মহিউদ্দিন আকবর ‘প্রত্যয়ী প্রসঙ্গ’ শিরোনামে বইটির যে সহ-ভূমিকা লিখেন, তা একটি স্বতন্ত্র কলামের মর্যাদা রাখে। তাই এটি আলাদাভাবে দেশ দর্শন ডটকমের পাঠকদের জন্য দেয়া হল। -সম্পাদক

বইটি অনলাইনে রকমারিতে অর্ডার করতে এখানে ক্লিক করুন]

 

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply