শুক্রবার দুপুর ২:৪৯, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

তসলিমার নাস্তিকতা ও শাবানার ডিগবাজি

জাকির মাহদিন

১. শাবানার এখনকার এই বয়সে জাগতিক মোহ আগের নগ্নতাগুলো থেকেও মারাত্মক- তার নিজের জন্য এবং জাতির জন্যও। কারণ আগেরটা ছিল অনেকটা শিক্ষা-পরিবেশ-সমাজ ও বয়সের দোষ। আর এখনকারটা সম্পূর্ণই তার নিজের। তা যদি হয় আবার ধর্মীয় ছদ্মাবরণে তবে আরো মারাত্মক। ২ . হেফাজত, আল্লামা শফী, মুফতি আমিনী, জাকির নায়েক, শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে এমন কোনো ধর্মীয় বিতর্কিত বা সামান্য বিতর্কিত ইস্যু নেই যা নিয়ে তসলিমার লেখনী চলেনি। এটা দিয়েই তার যাত্রা, এটা দিয়ে উন্নতি। এ দিয়েই সব স্বপ্ন-ভালোবাসা সাজানো।

সাবেক চিত্রনায়িকা শাবানার সাম্প্রতিক প্রচারমুখিতা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুক-অনলাইনে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত বাংলা ছায়াছবির পর্দা কাঁপালেও ধীরে ধীরে তিনি এ জগৎ থেকেই শুধু দূরে সরেননি, সবরকম মিডিয়া ও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। এমনকি তার অসংখ্য ভক্তও জানে না যে তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন। মাঝে মধ্যে মিডিয়া একটু-আধটু খবর দিত যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, বছরে একবার দেশে আসেন, মিডিয়া এড়িয়ে চলেন।

শোনা যায়, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকেও তিনি অনুরোধ করে আসছিলেন তার অভিনীত ছবি যেন দেখানো না হয়। তিনি নিজেকে আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত রাখেন, নামাজ-কালাম করেন, ধর্মের একান্ত অনুগত। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি চলচিত্রের ‘কল্যাণে’ আবার নিজেকে উৎসর্গ করলেন, ভিন্নভাবে। কাঁদলেন, কাঁদালেন। যৌবনোন্মাদনার সেই লাল-নীল জগৎ থেকে ফিরে এত ধর্ম-কর্ম করার পরও হঠাৎ তার মনে হল জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার আরো কিছু বাকি আছে। তাই তিনি বিশেষ মহল থেকে ‘আজীবন সম্মাননা’ গ্রহণ করলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসায় সমস্ত আবেগ ঢেলে দিলেন, নাচ-গানের জগতের উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে তার সহযোগিতা কামনা করলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

তার বক্তব্যের ভিডিওটি শুনলে হাসি পায়, আবার কান্নাও আসে। সাথে অনেক প্রশ্ন। আহা বেচারি! বাংলা পড়ায় কত দুর্বল! অলিখিত বক্তব্য দেয়ার মতো উপস্থিত বোধ-বুদ্ধি এখনো বিকশিত হয়নি। বক্তব্যটি তৈরি করতে একটি দল প্রচুর পরিশ্রম করেছে। কিন্তু তিনি সম্ভবত রিহার্সেলেরও সময় পাননি। বক্তব্য পাঠ করতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তবে উচ্চারণের স্পষ্টতা এবং এই বয়সেও কণ্ঠের কমনীয়তা অবাক করার মতো। সম্ভবত অভিনয়-জীবনের প্রথম দিকেই এটা রপ্ত করে ফেলেছিলেন।

লম্বা একটা হাসি সারাক্ষণই তার ঠোঁটে লেগে ছিল। মাঝে সামান্য সময়ের কান্না। সে কান্নায় সমস্ত আবেগ ঢেলে দিলেন। তার পরক্ষণেই আবারও লম্বা হাসি। কি নিখুঁত অভিনয়! কোটি টাকা ব্যয়ে জমকালো অনুষ্ঠান, বিশাল রঙিন হলরুম, রঙিন জগতের লাল-নীল নট-নটীদের সরব পদচারণা, সম্মাননা, বাজনা, করতালি। একেক জনের বিশ্ববিজয়ী হাসি। শাবানার ডিগবাজির ষোলকলা পূর্ণ। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়। তিনি আবার দেশে কোরআন শিক্ষা একাডেমিও খুলেছেন। আর যায় কোথায়? ‘নির্বাসিত লেখিকা’ হিসেবে পরিচয়দানে আগ্রহী, হিন্দি-বাংলা সিনেমা-উপন্যাসের এক সময়ের পোঁকা, হুজুর-মোল্লা, ধর্ম-কর্ম সংক্রান্ত ইস্যুর জন্য প্রায় প্রতিমুহূর্তে ওঁৎ পেতে থাকা তসলিমা নাসরিন তার লেখার কাঙ্ক্ষিত মাল-মশলা পেয়ে গেলেন। মুহূর্তেই হিংসায় জ্বলে উঠলেন। সুতরাং শাবানার এমন ডাবল ডিগবাজিতে তসলিমা লিখবেন না আর বাংলাদেশে কোনো বর্ষায় বৃষ্টি হবে না- এ সমান কথা।

নাসরিন কেবল ধর্মের চটুল সমালোচনার বাইরে কখনো কোনোদিন বেরুতে পারেননি। বের হতে চেষ্টা করেছেন বলেও আমার জানা নেই। কেন জানি না, সম্ভবত সেসব চটুল সমালোচনার জন্য যারা পুরস্কৃত করেছেন তাদের ঋণ শোধ আর জীবন-জীবিকার তাগিদ তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়।

হেফাজত, আল্লামা শফী, মুফতি আমিনী, জাকির নায়েক, শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে এমন কোনো ধর্মীয় বিতর্কিত বা সামান্য বিতর্কিত ইস্যু নেই যা নিয়ে তসলিমার লেখনী চলেনি। এটা দিয়েই তার যাত্রা, এটা দিয়ে উন্নতি। এ দিয়েই সব স্বপ্ন-ভালোবাসা সাজানো। সুতরাং এ নিয়ে না লিখলে নিমক হারামী হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে তসলিমার ‘মূল্যবান মতামত’ পেতে। এ ধরনের লেখকদের লেখা ছেপে তারা নিজেদের কথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ‘সাহসের’ পরিচয় দিয়ে থাকেন।

প্রয়োজনে তার ফেসবুক ওয়ালের পোস্ট প্রচার করতেও দ্বিধা করেন না। যদিও তার সব লেখা ও মতামত সেই নির্দিষ্ট দুয়েকটি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ ও চরমভাবে বিতর্কিত। প্রথম দিককার চিন্তা-দর্শন থেকে এখনকার চিন্তা-দর্শন একটুও এগোয়নি। তাছাড়া সমগ্র বিশ্বের জন্য তো অবশ্যই, ছোট্ট একটি দেশ, জাতি বা সমাজের জন্যও শুধু ধর্ম (প্রচলিত অর্থে) নয়, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি (গণনীতি) প্রভৃতিও অপরিহার্য। এসবের সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করতে লেখক-চিন্ত্যকদের গঠনমূলক সমালোচনা ও তাত্ত্বিক পর্যালোচনার বিকল্প নেই। কিন্তু জনাবা নাসরিন কেবল ধর্মের চটুল সমালোচনার বাইরে কখনো কোনোদিন বেরুতে পারেননি। বের হতে চেষ্টা করেছেন বলেও আমার জানা নেই। কেন জানি না, সম্ভবত সেসব চটুল সমালোচনার জন্য যারা পুরস্কৃত করেছেন তাদের ঋণ শোধ আর জীবন-জীবিকার তাগিদ তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়।

নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দানকারী তসলিমা এক্ষেত্রে কোনো নারীকেও ছাড়তে নারাজ। অবশ্য তাকেইবা দোষ দেই কী করে? ‘পুরুষের’ কট্টর সমালোচক তসলিমার এ পর্যন্ত যা উন্নতি-অগ্রগতি(?) তা সেসব পুরুষদের কল্যাণেই! তিনি প্রতিদিন প্রতিমাসে কয়জন পুরুষের সংশ্রব নেন আর কয়জন নারীর নেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে একটি কথা না বললেই নয়, ধর্মকে কটাক্ষ করে, কথিত পুরুষকে ‘পুরুষ’ নামে কটাক্ষ করে, নারীবাদ ও নারীস্বাধীনতার নামে আওয়াজ তুলে তসলিমা আজ বিশ্বব্যাপী ফেমাস। উন্নতবিশ্বে তার ‘মুক্তজীবন’ নিশ্চিত। তার চিন্তা-দর্শন বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহীত। ভক্ত-অনুসারীর সংখ্যা প্রচুর। তাহলে কি তিনি যা চেয়েছিলেন তা পেয়ে গেছেন, না পাননি? শেষ হিসেবটা তিনি, তার পাঠক, অনুসারী ও তার বিরোধীরা কে কিভাবে করছে?

শাবানার একটা বিশেষ মানসিক পরিবর্তন এসেছিল ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা যেভাবে স্থির থাকার কথা সেভাবে স্থির থাকেনি। সম্ভবত ধর্মীয় আরো সুস্পষ্ট ও গভীর ব্যাখ্যা তার নজরে পড়েনি বা কেউ তাকে দিতে পারেননি বলে। বয়স এবং অন্যান্য কিছু অভিজ্ঞতা ও চিন্তার আলোকে সাধারণ জগতের তো অবশ্যই, রঙিন জগতেরও অনেকেরেই একটা মানসিক পরিবর্তন ও ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এটা খুব বেশি অস্বাভাবিক না। তবে তা ধরে রাখতে এবং উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে আরো কিছু চিন্তা ও বিষয়ের প্রয়োজন হয়। নইলে বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতিতে সেটা বদলে যায় এবং সময়ে সময়ে ডিগবাজি খায়। শাবানার হয়েছে সেরকমই।

আমেরিকা-ইউরোপে যারা নওমুসলিম হচ্ছে তারা ধর্মতত্ত্ববিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, সেখানকার সমাজ-শিক্ষা-পরিবেশের প্রতিক্রিয়া দেখে। অথচ ধর্মের এমন সুস্পষ্ট, গভীর, মর্মস্পর্শী ও অলৌকিক ব্যাখ্যা আছে যা কেউ না শুনলে বা উপলব্ধির স্তরে সেখানে না পৌঁছলে বোঝানো সম্ভব না।

তার এখনকার-এই বয়সে জাগতিক মোহ আগের নগ্নতাগুলো থেকেও মারাত্মক- তার নিজের জন্য এবং জাতির জন্যও। কারণ আগেরটা ছিল অনেকটা শিক্ষা-পরিবেশ-সমাজ ও বয়সের দোষ। আর এখনকারটা সম্পূর্ণই তার নিজের। তা যদি হয় আবার ধর্মীয় ছদ্মাবরণে তবে আরো মারাত্মক। অবশ্য এক্ষেত্রে ধর্মীয় কিছু ব্যক্তিবর্গও কম দায়ি না। তাদের চিন্তা ও ব্যাখ্যার আলোকে অমুসলিমরা মুসলিম হবে দূরে থাক, মুসলমানরাই দলে দলে ইসলামবিদ্বেষী হচ্ছে। আর যেসব মুসলমান কোনো না কোনোভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তারাও নিজ অবস্থার ওপর অটল থাকতে পারছে না। আমেরিকা-ইউরোপে যারা নওমুসলিম হচ্ছে তারা ধর্মতত্ত্ববিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, সেখানকার সমাজ-শিক্ষা-পরিবেশের প্রতিক্রিয়া দেখে। অথচ ধর্মের এমন সুস্পষ্ট, গভীর, মর্মস্পর্শী ও অলৌকিক ব্যাখ্যা আছে যা কেউ না শুনলে বা উপলব্ধির স্তরে সেখানে না পৌঁছলে বোঝানো সম্ভব না। আজকের যেসব তাফসির, ফেকাহ, শিয়া-সুন্নি-ওয়াহাবী-আহমদী-মওদুদী ব্যাখ্যা ও চিন্তার সঙ্গে আমরা পরিচিত তা থেকে প্রকৃত ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, চিন্তা-দর্শন ও ইলম সম্পূর্ণই ভিন্ন। অনেক গভীর ও শক্তিশালী। সেসবের সামনে অস্ত্র, সম্পদ ও ক্ষমতা একান্তই দুর্বল। তেমন ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ও ধর্মীয় ব্যাখ্যাতা আজ গুটিকতক উপস্থিত থাকলেও নিশ্চিত বলা যায় বৈশ্বিক অসংখ্য সমস্যার সহজ সমাধান ঘটত।

‘ধর্ম’ আসলে কী এবং মানুষের ধর্মইবা কী? মানুষের ধর্ম একইসঙ্গে প্রাকৃতিক এবং স্রষ্টাপ্রদত্ত। প্রকৃতিটা যদিও স্রষ্টারই দান, কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ স্রষ্টাকে অস্বীকার করলেও প্রকৃতিকে অস্বীকার করছে না। তাই মানবিক যাবতীয় সমস্যার বৈশ্বিক সমাধানের পথ খোলা। মানবিক, বৈশ্বিক ও জাতিগত সমস্যার ধর্মীয় সুন্দর ব্যাখ্যাগুলো নিরপেক্ষভাবে পেশ করতে পারলে তসলিমা ও শাবানাদের একেকজন হয়ে উঠতেন মানবজাতির বিশাল সম্পদ। তসলিমা যদিও সাধারণত ধর্ম, পুরুষ ইত্যাদির চটুল সমালোচনা করতেই অভ্যস্ত, তবে তার লেখা ও সংগ্রামে একটা বিষয়ে গভীরতা আছে। সেটা হচ্ছে নারীর একটি বিশেষ চাহিদা। ওতে অনেক সত্যতা আছে। এর বিপরীতে সহজ সমাধানও আছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : লেখাটি বছরখানেক আগের, প্রকাশিতও হয়েছে দুয়েকটি সাইটে। তবুও দেশ দর্শনের পাঠকদের জন্য আবার দেয়া হল।

জাকির মাহদিন : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply