নেতারা এখন ভোটার দিয়ে দল ভারী না করে নেতা দিয়ে দল ভারী করে। কার পক্ষে কত নেতা আছে এটা দেখাতে পারলেই কেল্লাফতে। পাতি নেতা, চামচা নেতা, অখ্যাত-কুখ্যাত নেতা, মেয়াদোত্তীর্ণ নেতা। সব জায়গায় শুধু নেতার ছড়াছড়ি। এমনকি কেউ এখন আর ভোটার পরিচয় দেয় না। সবাই নিজেকে ‘নেতা’ পরিচয় দেয়। নেতার কোনো কর্মী আছে কি নেই সেটা জানার প্রয়োজন নেই। তাই এখন আর কোনো নেতা ভোটারদের ভরসা করে না। ভোটারদের নিয়ে কীভাবে জোট করা যায় সেই চিন্তা করে না।
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন মানেই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়া। এতে আনন্দিত হয় ভোটার-সমর্থকরা। ভোট এলেই ভোটারদের মাঝে ভালোলাগা কাজ করে, পছন্দের প্রার্থীকে পাস করিয়ে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। চলে নানান হিসাব নিকাশ। ভোট মানেই ভোটারের বিজয়। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারার মধ্যেই আনন্দ। অন্যদিকে প্রার্থীরা থাকে মহা টেনশনে। কীভাবে ভোটারদের মন জয় করা যায়, কাকে কীভাবে নিজের পক্ষে আনা যায়, কার মাধ্যমে আরো দশজন ভোটারের মতামত নিশ্চিত করা যায়, সে পরিকল্পনা সারাক্ষণ।
অথচ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ভোট নিয়ে এই সময়ের ভোটারদের কোনো আগ্রহ নেই। কারণ ভোটাররা জানে, বর্তমানে ভোটারদের ভোটে কেউ নির্বাচিত হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে ভোটই দিতে পারে না। একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে ফেলে। এমনকি মৃত মানুষও ভোট দেয় এখন। ভোটারদের ভোট কোনো কাজে আসে না জেনে অনেক ভোটার এখন ভোটকেন্দ্রেও যায় না। অন্যদিকে এখনকার প্রার্থীরাও ভোটারদের নিয়ে ভাবে না। ভোটারদের মন জয় করার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করে না। কারণ প্রার্থীরাও জানে, ভোটারের ভোটে কাজ হবে না। বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন ওপর মহলের গ্রিন সিগনাল। এজন্য এখনকার প্রার্থীরা ব্যস্ত থাকে নিজ দলের নেতা-নেত্রীর তোষোমোদে। অপেক্ষায় থাকে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীনদের আনুকুল্য পাওয়ার। নেতারা এখন ভোটার দিয়ে দল ভারী না করে নেতা দিয়ে দল ভারী করে। কার পক্ষে কত নেতা আছে এটা দেখাতে পারলেই কেল্লাফতে। পাতি নেতা, চামচা নেতা, অখ্যাত-কুখ্যাত নেতা, মেয়াদোত্তীর্ণ নেতা। সব জায়গায় শুধু নেতার ছড়াছড়ি। এমনকি কেউ এখন আর ভোটার পরিচয় দেয় না। সবাই নিজেকে ‘নেতা’ পরিচয় দেয়। নেতার কোনো কর্মী আছে কি নেই সেটা জানার প্রয়োজন নেই। তাই এখন আর কোনো নেতা ভোটারদের ভরসা করে না। ভোটারদের নিয়ে কীভাবে জোট করা যায় সেই চিন্তা করে না। কোন মন্ত্রবলে ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করা যায় সেই চিন্তা কারো মধ্যে নেই।
থাকবে কীভাবে? ভোটারই তো নেই, সবাই তো নেতা। এখন নেতায় নেতায় জোট হয়। জোটে ভোট বাড়ুক না বাড়ুক, তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু টক শো আর প্রেস ব্রিফিংয়ে দল ভারী করতে পারলেই মনে করে সাত রাজ্য জয় করে ফেলেছে। ভোটের এই জোটে সব থেকে বড় চমক দেখিয়েছেন রাজনীতিতে আনপ্রডিক্টেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৫৮টি দলের বিশাল জট লাগিয়েছেন তিনি। এরশাদের নেতৃত্বে এই ‘সম্মিলিত জাতীয় জোটের ভিতরে রয়েছে আরো দুটি জোট। ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ এবং ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট’। এই দুই জোটের অন্তর্ভুক্ত দল রয়েছে যথাক্রমে ৩৪ ও ২২টি। যার মধ্যে একটি দলেরও নেই নিবন্ধন। অর্থাৎ এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া নিবন্ধন আছে এই দুই জোটের বাইরে থাকা ‘বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের।
ভোটের খবর নাই, শুধু জোট আর জোট। একজন নেতা মানেই একটি দল। সেই হিসেবে দুজন নেতা হলেই একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করা এখন সময়ের ব্যাপার। একদম মুড়ি-মুড়কির মতো।
ভোটের জোটের এই খেলা ভোটের আগ পর্যন্ত চলবেই। এক একটা দল, দু-দুটো চেয়ার। বিশাল বিশাল এই জোট-মহাজোটে নেতাদের ভিড়ে কর্মী সমর্থকের জায়গা কই! এক সম্মিলিত জোটের ৫৮ বা ৫৯ দলের ৫৯ নেতার জন্য উপযুক্ত চেয়ার সম্বলিত কোনো প্রেস কনফারেন্স সম্ভবত দেশে নেই। তার ওপর প্রত্যেকটি জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর যা চাহিদা। ভোট দূরে থাক, নেতা নেই ১০টা, অথচ সংসদে আসন চায় ১০০! কোনো জোটের দলগুলোর চাহিদা পূরণ করার মতো আসন সংখ্যাও পার্লামেন্টে নেই।
সর্বশেষ এরশাদের সাথে আরেকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ যোগ দিলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৯-এ। অর্থাৎ ‘সম্মিলিত জাতীয় জোটে’ রয়েছে ৫৯টি রাজনৈতিক দল। যেগুলোর দুচারটা বাদে বাকিগুলোকে জোট-মহাজোট দূরে থাক, দল বলাটাই হাস্যকর। দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, অঘোষিত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বর্তমানে জনপ্রিয়তা কতটুকু আছে তার জরিপ অবশ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু দলটির বর্তমান করুণ দশা দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের জানা আছে। দলীয় প্রধান দুর্নীতি মামলায় জেলে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান আদালতে ঘোষিত সাজাপ্রাপ্ত আসামী বিদেশে আশ্রিত। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা শীর্ষ নেতাদের গা-ঢাকা দেয়া, কারাবরণ করা, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মামলা-হামলায় কোণঠাসা। সর্বশেষ, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একজন কারাবন্দি, অন্যজন বিদেশে। মোটামুটি নেতৃত্বশূন্য বিএনপি।
দলটি না পারছে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে, না পারছে স্বস্তিতে থাকতে। বয়স হয়ে গেলে যা হয় বিএনপির অবস্থা এখন তাই। কারো উঠে দাঁড়ানোর শক্তি না থাকলে ছোট বাচ্চা বা মরা শুকনা গাছের ওপর ভর করে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নিতে হয়। বিএনপিও তাই করেছে। রাজনীতিতে শিশু বাচ্চা বলা চলে এমন দল এবং সেই সঙ্গে ডেটওভার বা মরা গাছের মতো দল মিলে গড়েছে জাতীয় ঐক্য। যারা শুরুতেই খেয়েছে ভাঙনের। অথচ দল মাত্র বিএনপি বাদে তিনটি। তিনটি দলেরই ১০০ জন কর্মী জায়গা দেয়ার মতো রাজনৈতিক কার্যালয় নেই। তার মধ্যে দুটি দলে মাত্র দুজন নেতার নামও রাজনৈতিক সচেতনরা এক শ্বাসে বলতে পারবে না।
এখানেও জোটের ওপর জোট। আগে থেকেই বিএনপির নেতৃত্বে রয়েছে ২০ দলীয় জোট। নুতন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামের জোটে বিএনপির থাকা মানে নীতিগতভাবে সমর্থন দেয়া অন্যান্যরাও আছে। এদিকে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনে শুরু থেকে সক্রিয় থাকা বিকল্পধারা বাংলাদেশকে কৌশলে বাদ দেয়া হয় জোট থেকে। অন্যদিকে নামসর্বস্ব দলের সাথে জোট করায় মনক্ষুণ্ন হয়ে বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে গেছে ন্যাপ ও এনডিপি। সংবাদ সম্মেলন করে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরদিনই দল দুটি বিকল্পধারার আমন্ত্রণ পায়। ইতোমধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে এই তিন দলের সম্ভাব্য নতুন জোট নিয়ে। মানে ভোটের খবর নাই, শুধু জোট আর জোট। একজন নেতা মানেই একটি দল। সেই হিসেবে দুজন নেতা হলেই একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করা এখন সময়ের ব্যাপার। একদম মুড়ি-মুড়কির মতো। প্রয়োজনে সদ্য নামে প্রসব করা দল নিয়ে হলেও জোট গঠন করতে হবে।
এর একটা কারণ অবশ্য আছে। এখন আর আগের মতো এক নেতার এক দল কোথাও ফ্লোর পায় না। প্রেসক্লাবেও সাংবাদিকরা তাদের গুরুত্ব দেয় না। জোটফোট হলে যদি একটু ফ্লোর পাওয়া যায়, অন্তত কৌতুহলে হলেও। হাসির খোরাক হলেও পত্রিকার পাতায় বড় হেডিং পাওয়া যায়। ভোটের জোটের এই খেলা ভোটের আগ পর্যন্ত চলবেই। এক একটা দল, দু-দুটো চেয়ার। বিশাল বিশাল এই জোট-মহাজোটে নেতাদের ভিড়ে কর্মী সমর্থকের জায়গা কই! এক সম্মিলিত জোটের ৫৮ বা ৫৯ দলের ৫৯ নেতার জন্য উপযুক্ত চেয়ার সম্বলিত কোনো প্রেস কনফারেন্স সম্ভবত দেশে নেই। তার ওপর প্রত্যেকটি জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর যা চাহিদা। ভোট দূরে থাক, নেতা নেই ১০টা, অথচ সংসদে আসন চায় ১০০! কোনো জোটের দলগুলোর চাহিদা পূরণ করার মতো আসন সংখ্যাও পার্লামেন্টে নেই। অর্থাৎ এখানেও জট লাগা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পাত্রের চেয়ে পাত্রে রাখার উপাদান বেশি হলে জট লাগা নিশ্চিত। যেমনটি ঢাকার শহরে রাস্তার চেয়ে পরিবহণ বেশি হওয়ায় যানজট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চার দলীয় ঐক্যজোটের পর ২০ দলীয় জোট। ১৪ দলীয় মহাজোট। ৫৯ দলীয় সম্মিলিত জাতীয় জোট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনের আগে আরো কী কী জোট আসতে পারে তার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা লাগবে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, নতুন কোন দলের আত্মপ্রকাশ করছে সে প্রশ্ন না করে নতুন কোন জোট আত্মপ্রকাশ করছে সেটাই মুখ্য। জোটের পরে জোট, তার ভিতরেও জোট।
শাহনূর শাহীন : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]