যারা ধর্মের নামে কল্কি টেনে ভেল্কি দেখিয়ে কিংবা হেলিকপ্টারে এসে খেঁজুর পাতার বয়ান করে জনগঙ্গায় দাঙ্গা লাগিয়ে ডাঙায় বসে থাকে। অতপর মাইক্রোফোন হাতে হাঁক ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেওয়ার। উস্কে দেয় তাদের অন্ধ ভক্তদেরকে; পরিণামে রক্ত রক্ত খেলা। আধিপত্য বিস্তারে প্রাণ কেড়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা কেবল প্রতিযোগিতায় আর সীমাবদ্ধ নেই, এখন তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রবণতায় পৌঁছেছে। বহুকাল ধরেই ধর্মের বাঁশি দ্বারা সুরের রেষারেষির অশুভ পরিণতি উভয় ধর্মের ধর্মানুসারীরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে আসছে।
এককালে বসন্ত এলেই নিষ্প্রাণ প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেতো। আর এখন নির্জীবতা প্রায় পরখ করার মতো। তখনকার হাওয়ায় কেবলই অক্সিজেন থাকতো। আর এখন হিংসা-বিদ্বেষসহ আরো কত কী মিশে আছে, তা অজানা। শ্বাস নিলেই প্রশ্বাসে অশান্তি অনুভব হয়। তখন কোকিলের কন্ঠে সুমধুর সুর শ্রবণিত, আর এখন চারপাশে মনুষ্যের বিভীষিকাময় চিৎকার-মৌন বিলাপ। আজ বড্ড বেপরোয়া স্বভাবে স্বকীয়তা হারিয়েছে মানুষ। সাধ মিটিয়ে ধর্মের অপব্যবহার করেও থেমে নেই। ধর্মের বাঁশিতে স্বার্থের সুর তুলে জাত ভাইয়ের রক্তে স্নান করতে দ্বিধাবোধ করে না।
মানুষ কে? শ্রেষ্ঠ জীব। বাকিসব প্রাণীর সঙ্গে তুলনাযোগ্য? না। দেখতে এবং আকৃতিগত দিক থেকে অনেক সুন্দর এবং অনন্য। তবে চরিত্রের বেলায় কেবল চতুষ্পদ নয়; বরং চতুষ্পদ জন্তু মানুষকে ভগবান মানবে। প্রশ্নের বিপরীতে উত্তরগুলো পুনরায় প্রশ্নের জন্ম দেয়। অবকাশে শ্মশানে বসে ওসব এলোমেলো। চিন্তাগুলো আমাকে অগোছালো করে দেয়। সমাজে এখনকার তাদের দেখে অবাক না হয়ে পারি না, যারা ধর্মের নামে কল্কি টেনে ভেল্কি দেখিয়ে কিংবা হেলিকপ্টারে এসে খেঁজুর পাতার বয়ান করে জনগঙ্গায় দাঙ্গা লাগিয়ে ডাঙায় বসে থাকে। অতপর মাইক্রোফোন হাতে হাঁক ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেওয়ার।
উস্কে দেয় তাদের অন্ধ ভক্তদেরকে; পরিণামে রক্ত রক্ত খেলা। আধিপত্য বিস্তারে প্রাণ কেড়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা কেবল প্রতিযোগিতায় আর সীমাবদ্ধ নেই, এখন তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রবণতায় পৌঁছেছে। বহুকাল ধরেই ধর্মের বাঁশি দ্বারা সুরের রেষারেষির অশুভ পরিণতি উভয় ধর্মের ধর্মানুসারীরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে আসছে। সাম্প্রতিককালে আকীদার মারপ্যাঁচে স্বধর্মের রক্তে স্নান করা শুরু হয়ে গেছে, যা নুতন করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জনসাধারণের মধ্যে। ধর্মটাকে রেস্টুরেন্টের কলিং বেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কাস্টমারের আগমন-বহির্গমনে যেমন করে ম্যানেজার মহোদয় চেপে বসেন কলিং বেলে, ঠিক তেমনিভাবে নামাজের আগে-পরে, সভা কিংবা সেমিনারে, বাজারে-মাজারে মোটকথা সর্বস্থানে আকীদার দোহাই দিয়ে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের বিপক্ষে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করেছে।
অশ্রাব্য কথার কাদা এখন রক্তের কাদায় পরিণত। পূর্বে ব্যথার অন্তরায় অশ্রাব্য কথ্যকাদা বর্তমানে কাদার অন্তরায় রক্তকাদা। ওরা স্বার্থান্বেষী, ওরা দাঙ্গাবাজ। কেবল বাহ্যিকে দেখায় মোল্লাত্ব। ওরা ইবলিশ, ওরা পকেটবাজ, বিলুপ্ত হয়েছে তাদের মনুষ্যত্ব। ওরা জানে মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়ে বেঁচে যাওয়া মুশকিল। আর ওরা ভালো করেই জানে যে… There is no religion greater than humanity. হিন্দুত্ব-মুসলমানিত্বের প্রভাব মেনে নেয়া যায়। কিন্তু তাই বলে আকীদাত্বের প্রভাব মেনে নেয়া যায় কীভাবে? ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন অভিধান হতে পারে, ভিন্ন হতে পারে ধর্মের পথ নির্দেশকগণ। C8 কিন্তু আকীদার পথ নির্দেশক ভিন্ন হয় কীভাবে? হিন্দু-মুসলমানের ভগবান একজন, এটা সত্য। তবে বিশ্বাসে ভিন্নতা আছে। হিন্দুদের ভগবান তাঁর কর্মসকল তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে বন্টন করে দিয়েছেন আর মুসলমানের যিনি তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনিই সর্বশক্তিমান। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার টিকি ও দাড়ি নিয়ে পুরাতন পন্ডিত্ব ও মোল্লাত্ব ইদানিং ততটা পরখ করার মতো না হলেও মুসলমানের মধ্যকার দাঁড়িয়ে-বসে দুরূদ পড়া নিয়ে যে নতুন ‘ত্ব’র সৃষ্টি হয়েছে তা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।
সত্য সুন্দর অলক্ষ্য খোদার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর সৃষ্টিকুল কেবল তাঁরই অর্চনা করবে, পুজো করবে। কিন্তু একি আহামরি অবস্থা! মনুষ্যত্ব হিন্দুত্বে ও মুসলমানিত্বে পরিণত হয়েছে। মুসলমানিত্ব আজ আকীদাত্বে পরিণত হয়েছে। একসময় হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব মধ্যকার টিকি ও দাড়ি নিয়ে দাঙ্গা ছিলো। আজকাল মুসলমানিত্ব থেকে নতুন করে আকীদাত্ব জন্ম নিয়েছে। আকীদাত্বের কিয়ামত্ব আর এক বিড়ম্বনা! এই ত্ব-এর উপর ভিত্তি করে একে-অপরকে মুনাফেক-কাফের-মুশরেক সম্বোধন করে কথার কাদা ছুঁড়ছে। লুঙ্গি ছেড়ে পাগড়ির টান আর ফরজ ছেড়ে মুস্তাহাবের বয়ান- বাক্য দুটি সমানে সমান। আপনার লুঙ্গি পরিধানের সৌন্দর্যতার চেয়ে যদি পাগড়ি পরিধানের সৌন্দর্যতা বেশি প্রকাশ পায়, তাহলে বাকিসব মানুষ যেমন করে হাসবে ঠিক তেমনি ফরজ ছেড়ে মুস্তাহাব নিয়ে টানাটানি করে নিজেদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ দাঙ্গা লাগালে ভিন্ন ধর্মাবলম্বরীরাও হাসবে এবং পাশাপাশি সেই সুযোগটাও কাজে লাগাবে ও লাগাচ্ছে।
ফিলিস্তিন-কাশ্মীর-মায়ানমার-সিরিয়া- সবকটি আমাদের দাঙ্গার ফল, আকীদাত্বের প্রভাব, অনৈক্যের প্রতিক্রিয়া এবং আভ্যন্তরীণ আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। এমন বৈশ্বিক অপ্রীতিকর অকল্পনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পিছনে মুসলমানিত্বে ঐক্যের অনুপস্থিতি অলক্ষ্য থেকে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এই অনৈক্যের পেছনে লেবাসধারী গুটিকয়েক হুজুর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাজারে কল্কি টেনে ভেল্কি দেখিয়ে আবার কেউ কেউ হেলিকপ্টারে এসে নবী সা. এর খেজুর পাতার বিছানার বয়ান করে লক্ষ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রায়শই দাঁড়িয়ে-বসে দরূদের কিয়ামত্ব বিষয়ক অপ্রয়োজনীয় (বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে) দরবার-বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়ে যায়। অতঃপর রক্ত রক্ত খেলার প্রতিযোগিতা আর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো বিভীষিকাময় প্রবণতা। পয়গম্বর বলেননি তিনি ওহাবী-সুন্নি-শিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি আকীদার জন্যে এসেছেন। তিনি এসেছিলেন মানুষের জন্য, মুক্তির পথ দেখাতে। তিনি বলেননি দুরূদ নিয়ে টানাহেঁচড়া কর, দাঁড়িয়ে-বসে পড়। তিনি বলেছেন শুধু পড় এবং মনোযোগ সহকারে পড় (আমল কর)।
তিনি বলেননি আমাকে সম্মান করার জন্যে পড়! তিনি বলেছেন, তোমাদের লাভের/কামিয়াবির জন্য পড়। মোটকথা এটাই সত্য যে পয়গম্বরকে সম্মান না করলে পয়গম্বরের সম্মান কমবে না বরং আমাদেরই অকল্যাণ হবে। তবু এই উঠা-বসা অর্থাৎ কিয়াম নিয়ে মুহাম্মদ সা.কে বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে একদলীয় সম্পত্তি। এই কেয়ামত্ব নিয়েই যত বিপত্তি। স্পষ্ট মনে আছে, শৈশবে এক পূর্ণিমার রাতে মামার বাড়ির উঠোনে কানামাছি খেলার সময় সমবয়সী মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিবাধে জড়িয়েছিলাম প্রিয় চাঁদকে নিয়ে। সে বলছিল, চাঁদটা তার এবং তার সঙ্গেই চলে। আমিও তাই বলেছিলাম, এটা আমার এবং আমার সঙ্গেই চলে। পরবর্তীতে বুঝলাম চাঁদটা সবার ও সবার জন্যেই এবং সবার সঙ্গেই চলে। ধর্ম যার যার, স্রষ্টা-পয়গম্বর সবার। ধর্মের বাঁশিতে স্বার্থের সুর তোলে স্রষ্টা-পয়গম্বর নিয়ে নতুন করে আকীদাত্ব-কেয়ামত্ব নামক দুই ‘ত্ব’ এর সৃষ্টির কারণে আজ সমগ্র বিশ্বে মুসলমান-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়েছে, চরম অনৈক্য বিরাজ করছে। ফলস্বরূপ ভিন্ন ধর্মালম্বী কর্তৃক বিশ্ব মুসলিম শোষিত নির্যাতিত হচ্ছে।
আফসোস! তাদের জন্য যারা কল্কি টেনে ভেল্কি দেখিয়ে আর হেলিকপ্টারে খেজুর পাতার বয়ান করে কেয়ামত্বের জন্ম দিয়েছে। তারা যদি কখনো শ্মশানে কিংবা গোরস্থানে স্বল্প সময়ের জন্য ধ্যানে মগ্ন হয়ে এ ভবের ভুবনে আসা-যাওয়ার মূল উদ্দেশ্যটা খোঁজার চেষ্টা করতো, তাহলে হয়তো পেয়ে যেতো। হয়তোবা জেনে যেতো সত্য-অসত্যের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে। বুঝতো স্রষ্টার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। কেননা, জনগঙ্গায় দাঙ্গা লাগানোর পেছনে কল্কি বাবা আর হেলিকপ্টার বাবাদের পেছনে ইবলিশ দাদা বিরাজ করে থাকে আর শ্মশানে কিংবা গোরস্থানে মৃতের আত্মা ও স্বয়ং এঁকেশ্বর বিরাজমান। যেখানে ইবলিশ সেখানে সত্য আর অসত্যের মিশ্রণে মিথ্যের চেয়েও ভয়ংকর অবস্থা অপেক্ষয়মান। আর সেই ভয়ংকর অবস্থার প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ইদানিংকার আকিদাত্ব তথা কিয়ামত্বের অত্যাধিক চর্চা।
স্রষ্টা আর সৃষ্টির মুখোমুখি পরিস্থিতিতে ন্যায় বিচারালয়ে ইবলিশের প্রবেশাধিকার নেই। সত্য সুন্দর স্রষ্টা সম্পর্কে সংবেদনশীল হতে এবং পরকালের ক্ষেতে নিজেকে সৎ উপায়ে নিযুক্ত করতে শেষ আবাসস্থলে ক্ষণিক মুহূর্ত ব্যয় করা অপরিহার্য। ঐক্ই হোক আমাদের হাতিয়ার। ‘ত্ব’ তন্ত্র হোক নির্বাসিত। শত্রুরা হোক হুঁশিয়ার, শান্তি হোক প্রতিষ্ঠিত।
সারোয়ার খান : বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ
১২ই অক্টোবর, দুই হাজার আঠারো
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]