শুক্রবার রাত ৯:৫৭, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

দুর্নীতির মূলে আমাদের অতিরিক্ত চাহিদা

মুহাম্মাদুল্লাহ কাওসার

চাকরিজীবীদের ব্যাপারেও একই ব্যপার। তার চাহিদারেখা আয়ের সীমা অতীক্রমকারী। সীমার মধ্যে রাখতে চাইলেও পারে না, সামাজিক পারিবারিক চাপে। তার সন্তান ছয়টা-সাতটা প্রাইভেট পড়বে এই হিসাব করে বেতন নির্ধারণ করা হয়নি। আবার বেতন বাড়ানোর নির্দেশ যে দিন দেয় এর পরদিন থেকেই সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। বেতন বাড়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে। দাম বাড়ে প্রতিটি পণ্যে, প্রতিটি কাজে। এ থেকে মুক্তির পথ কী?

পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, সমাজ ও জাতির মানুষ তাদের নিজ নিজ চাহিদাকে সঙ্গে করেই সময়ের স্রোতে এগিয়ে চলছে। মানুষের এই চাহিদার তুলনায় যখন যোগান কম হয়, তখন দেখা দেয় অভাব। অভাবের তাড়না থেকে একটু স্বস্তি পেতেই যতসব দুর্নীতি-অনাচার-অবিচার-অনিয়ম।

এখন প্রশ্ন হল, মানুষের চাহিদা কতটুকু? এর মধ্যে কতটুকু যৌক্তিক আর কতটুকু অযৌক্তিক এবং এর মাপকাঠি কী? সমাজ একটা চাহিদা বেঁধে দিয়েছে। যাকে বলা হয় মৌলিক চাহিদা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা। নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিনোদন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কর্মীদের বেতন নির্ধারণ করে, এ চাহিদাগুলো মাথায় রেখেই করে। তাই যদি হয় তাহলে তারপরও মানুষ কেন তার মৌলিক চাহিদা নির্ধারিত ইনকামে পূরণ করতে পারছে না?

তাহলে কি এ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের চাহিদা বুঝছে না, না মানুষের চাহিদার সাথে তাদের চাহিদা খাপ খাচ্ছে না? যদি তাই হয় তাহলে তো সমস্ত দুর্নীতি-অনাচারের মূলে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কারণ তারাই বাধ্য করছে মানুষকে অসৎ পথে চলতে। নাকি মূল সমস্যা চাহিদামুখী মানুষদের? তাদের চাহিদা সীমাতিরিক্ত। এমনটা হলে সরকার বা প্রতিষ্ঠান যোগান কয়েকগুণ বাড়ালেও চাহিদা-যোগনের পাল্লা সমান করা সম্ভব নয়।

মানুষ চাহিদামুখী। প্রথমেই আলোচনা করা যাক শিক্ষকের কথা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি কল্পনা করা নিছক বোকামি। আর এর মূল চাবিটা থাকে শিক্ষকের কাছে । তার স্বাভাবিক চাহিদা তো এটাই যে ছাত্রকে পড়াবে। তাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলবে। এর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠান তাকে যা দিবে তা দিয়েই যেভাবে চলা যায় চলবে। এটাই তাকে সমাজ-বেঁধে দেওয়া চাহিদা। কিন্তু এই সমাজ থেকেই যখন একজন শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের কথার মুখোমুখি হতে হলো, তখন তিনি বেছে নিলেন ভিন্ন পথ। শিক্ষক মানেই দরিদ্র। ছাতি লাঠি নিয়ে চলবে। গাছতলায় থাকবে। শিক্ষকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে না-চাওয়া, আত্মীয়তা না রাখা। এসব দেখে তিনি ধরলেন নতুন পথ। স্কুলের ক্লাসে অবহেলা, প্রাইভেটে অধিক যত্ন নেওয়া, পরীক্ষার সময় প্রাইভেটের ছাত্রদের আলাদা কেয়ার ইত্যাদি। ক্লাসে এক নিয়মে পড়ানো, প্রাইভেটে অন্য নিয়মে। যেন পরীক্ষার সময় খাতা পার্থক্য করতে সহজ হয়।

এভাবেই দিনে দিনে প্রাইভেটে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এমন শিক্ষকও আছেন, যাদের কাছে এই পরিমাণ ছাত্র প্রাইভেট পড়ে যা একটা ছোটখাটো স্কুলের চেয়ে বেশি। এবার তার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। গাছতলা থেকে তিনি এখন বহুতল ভবনে। ছাতি লাঠি থেকে গাড়িতে। এই প্রাইভেট-দুর্নীতি দূর করার জন্য অনেকেই অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। কোনো কাজ হয়নি। তাই এবার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন তরুণ সমাজের।

জীবনে অনেকেরই অনেক আন্দোলন করা হলো। এবার করা যেতে পারে নতুন একটা আন্দোলন, ভিন্নরূপে। আন্দোলনের ভাষা হবে, প্রাইভেট পড়তে চাই না, স্কুলেই সব বিষয় যত্ন সহকারে পড়িয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনটাও আমরাই করবো। এর দ্বারা এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার দরুন অন্যজনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রক্ষা পাবে। একটা ছোট শিশু, সে ছোট থেকেই দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে জীবনের বুনিয়াদ গড়ে তুলছে; কেননা সে শিক্ষার পাশাপাশি দুর্নীতিটাও পাচ্ছে তার শিক্ষকের কাছ থেকে। যা থেকে তার আত্মরক্ষা করতে হবে।

চাকরিজীবীদের ব্যাপারেও একই কথা। তার চাহিদারেখা আয়ের সীমা অতীক্রমকারী। সীমার মধ্যে রাখতে চাইলেও পারে না, সামাজিক পারিবারিক চাপে। তার সন্তান ছয়টা-সাতটা প্রাইভেট পড়বে এই হিসাব করে বেতন নির্ধারণ করা হয়নি। আবার বেতন বাড়ানোর নির্দেশ যে দিন দেয় এর পরদিন থেকেই সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। বেতন বাড়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে। দাম বাড়ে প্রতিটি পণ্যে, প্রতিটি কাজে। এ থেকে মুক্তির পথ কী? সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উপায় আছে! একটা কর্মক্ষেত্র আছে যেখানে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে কম হয়, তাহলো সামরিক বিভাগ। যাদের বেতন তুলনামূলক বেশি। পরিবারসহ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও উন্নত। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাসিক নির্দিষ্ট ভাতাও থাকে। সরকার কি পারবে তাদের মতো অন্যদের সুযোগ দিতে?

সব দিকে না পারলেও হয়তো একদিকে পারবে। যা হয়তো অনেকাংশেই করতে পেরেছে। তারপরও তো কেউ কেউ চোখের চাহিদায় আবার কেউবা অভ্যাসের দাস হয়ে দুর্নীতি করেই যাচ্ছে । আর বেসরকারি চাকরীতে উপরের পদে যারা থাকে তাদের বেতন পরিশ্রম সবই বেশি । আর নিম্নস্তরে যারা আছে তারা দুর্নীতি করলে তো কিছু করার নেই । কারণ তাদেরকে আমরা দুর্নীতি করতে বাধ্য করি । পরিশ্রমতুল্য পারিশ্রমিক না দিয়ে নিজের পকেট ভারি করতে চাই ।

ব্যবসায়ী। যারা সমাজের বড় একটা চাহিদার যোগান দেয়। এরাই বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে জনগণের কোনো আপত্তি নেই পণ্যের দাম বাড়াতে, তাদের আপত্তি ওঠে পণ্যে ভেজাল মিশালে। কারণ টাকা দিয়ে তো কেউ আর বিষ খেতে চায় না। কেন পণ্যে ভেজাল মেশানো হয়? অধিক লাভের জন্য। লাভ তো কিছুটা হয়ই। তবে বেশি একট না। কারণ যে পরিমাণ পণ্য কিনেছে সে পরিমাণ থেকে তো আর বাচ্চা বেশি বিক্রি করতে পারবে না। তাহলে কি সরকারের অধিক ভ্যাট চাপানো তাদেরকে বাধ্য করছে বামপথে!

আবার সরকারও তাদের জন্যই নিজের সিদ্ধান্তে পর্যন্ত নড়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। সকলে একজোট হয়ে ব্যবসায়ীদেরকে বলে ‘আমরা এ ধরনের নীতিতে পণ্য ক্রয় করবো না। প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ব্যতীত অন্য কিছু ক্রয় করবো না।’ খাদ্যসামগ্রী ক্রয়েও সচেতন হবে। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো, ফর্মালিন দিয়ে রেখে দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারী কর্মকর্তাদের সততার সহিত তাদের উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। কারণ মৌলিক চাহিদার প্রথমটাই যদি ব্যহত হয় তাহলে তো বাকিগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ।

সমস্যা থাকবেই । সমাধানের পথটা খুঁজে আমাদেরকে সামনে বাড়তে হবে। পুরনো পথে হাঁটলে যদি সমাধান না আসে তবে অভিনব পথ আবিষ্কার করতে হবে । ভাবতে হবে নতুন করে । আবার । আরো একবার।

মুহাম্মাদুল্লাহ কাওসার : প্রাবন্ধিক, ভাষা প্রশিক্ষক

kausar002@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply