শুক্রবার রাত ১১:৫৪, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং

নতুন সড়ক পরিবহন আইনের সমস্যাগুলো

জান্নাতুল কারার তিথি

১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর হলো ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। ইতিমধ্যে এ আইন নিয়ে আলোচনা-সমলোচনার ঝড় উঠা শুরু হয়েছে জনগণের মনে। বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করে সাজা ও জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে এই আইনে। সড়ক পরিবহন ক্ষেত্রে যদি এ আইনটি যথাযথ প্রয়োগ করা সম্ভব হয় তবে দুর্ঘটনার হার কমবে- এই আশা করা যায়।

আমাদের দেশে পুস্তকবন্দী আইন আর প্রায়োগিক আইনের মাঝে একটি বিরাট তফাৎ আছে। অনেক ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয় না। আর যদিওবা প্রয়োগ হয় সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের দেশের সড়ক পরিবহন আইনটির প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও তার ভিন্ন হবার কথা নয়। এ আইনের কিছু ক্ষেত্র এখনো মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। আর যেটা আইনের প্রয়োগে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা রাখি তা হলো-

এক. আইনে ট্রাফিক সংকেত অমান্য করলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্ত ট্রাফিক সিগনাল বা লাল-সবুজ বাতিগুলো অধিকাংশ সড়কে অকেজো। সেক্ষেত্রে চালকদের ভরসা থাকে ট্রাফিক সার্জেন্টদের হাতের ইশারার উপর। আবার অনেক চৌরাস্তায় একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট থাকায় তাদের দিকনির্দেশনা বুঝতেও চালকদের সমস্যা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে শুধু আইন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান আদৌ করা সম্ভব নয়।

“লাইসেন্স না থাকলে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক দিকে তাকালে দেখা যায়, যদি কোন ব্যক্তি লাইসেন্স করতে যান তবে তাকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে লাইসেন্স হাতে পাবার জন্য। লার্নার কার্ড হাতে পেলেও সেটা গ্রহণীয় নয়। আবার লাইসেন্সের পরীক্ষা থেকে কার্ড হাতে পেতে বিশাল সময়ের ব্যবধান।”

দুই. অবৈধ পার্কিং করলে আনা হয়েছে জরিমানার বিধান। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অধিকাংশ রাস্তায় বৈধ পার্কিং-এর জন্য কোন জায়গার বরাদ্দ নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে অবৈধ পার্কিং করা ছাড়া ভিন্ন কোন ব্যবস্থা কি আদৌ নেয়া হয়েছে? তিন. যত্রতত্র রাস্তা পারাপার করলে জরিমানা। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অনেক প্রয়োজনীয় রাস্তায় পারাপারের জন্য যেমন জেব্রা ক্রসিং নেই, আবার ফুটওভার ব্রিজের সংখ্যাও তুলনামুলক কম। আবার অনেক রাস্তায় ফুটওভার ব্রিজ নেই।

চার. লাইসেন্স না থাকলে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক দিকে তাকালে দেখা যায়, যদি কোন ব্যক্তি লাইসেন্স করতে যান তবে তাকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে লাইসেন্স হাতে পাবার জন্য। লার্নার কার্ড হাতে পেলেও সেটা গ্রহণীয় নয়। আবার লাইসেন্সের পরীক্ষা থেকে কার্ড হাতে পেতে বিশাল সময়ের ব্যবধান। এই জটিলতা নিরসন না করে কি আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব! এছাড়া বিআরটিএতে গেলে যে হয়রানি শিকার হতে হয় সেখানে মানুষের দালালনির্ভর না হয়ে উপায় থাকে না। অন্যদিকে লাইসেন্স করতে গিয়ে ঘুষ না দেওয়া হলে লাইসেন্স হাতে পেতেও কম ধকল পোহাতে হয় না। সেখানে একজন মানুষকে হয় ঘুষনির্ভর নয়তো দালালনির্ভর হতে পরিস্থিতিই অনেকটা বাধ্য করে থাকে।

আরো পড়ুন> মানুষ হও হে নারী বা পুরুষ

আবার অতিরিক্ত ওজন বহনকারী গাড়ি বা নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির জন্য আইনে বিধান থাকলেও বাস্তবে সেটা তদারকি না করার ফলে মানুষ অবাধে আইনের লংঘন করে যাচ্ছে। আইনের স্পষ্ট প্রয়োগে যেমন রয়েছে গাফলতি, তেমন এই আইন প্রয়োগে কর্মরত অফিসারদের রয়েছে নিষ্ঠা ও সততার অভাব। নতুন আইন হওয়া তাদের কাছে নতুন নতুন আয়ের উৎস। সেক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের যে নীরব ভুমিকা থাকে তা নতুন আইনের সাথে প্রশাসনিক অন্যায়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে।

“সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের ভূমিকা রাখা তখনি সম্ভব হবে, যখন আমরা নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে একজন সচেতন নাগরিকের ভূমিকা রাখতে পারবো। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের যেমন আইন পালন করা উচিত, ঠিক তেমনি আইন পালনের যথাযথ ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার জন্য সরকার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা পালন করতে হবে।”

একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি, সড়ক পরিবহনে সাজা বা জরিমানার বিধানের সাথে সাথে এর পিছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধান করা অত্যন্ত জরুরী। এ আইন কার্যকর করতে যেসব উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজনীয় মনে করছি- এক. বিআরটিএ থেকে যাতে সহজে গাড়ি বা মোটরযান রেজিস্ট্রেশন বা ড্রাইভিং লাইসেন্স করা যেতে পারে সেক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে বিআরটিএ-কে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। দুই. ট্রাফিক আইনের ধারাগুলো পুনরায় সংশোধন করে কঠোর করা হোক এবং ট্রাফিক সার্জেন্টদের কাজের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিন. ঝুঁকিপূর্ণ সড়কগুলোর উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের যথাযথ ভূমিকা রাখা যেতে পারে।

লেখকের সব লেখা

চার. অধিকাংশ রাস্তায় ট্রাফিক সিগনাল থেকেও নেই। আর যেখানে আছে সেগুলোও না থাকার মতো। তাই ট্রাফিক সিগনালগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। কারণ ট্রাফিক সার্জেন্টদের হাতের ইশারা মাঝে মধ্যে চালকের বোধগম্য নাও হতে পারে। আবার চৌরাস্তায় একাধিক ট্রাফিক পুলিশ থাকায় একেকজনের নির্দেশনা একেক রকম হয়ে থাকে। তখন চালকের জন্য নির্দেশনা মানা খুব একটা সহজ হয়ে উঠে না। তাই ট্রাফিক সিগনালগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। পাঁচ. যার যার অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন হচ্ছে কিনা সেটার তদারকি করাও জরুরী।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের ভূমিকা রাখা তখনি সম্ভব হবে, যখন আমরা নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে একজন সচেতন নাগরিকের ভূমিকা রাখতে পারবো। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের যেমন আইন পালন করা উচিত, ঠিক তেমনি আইন পালনের যথাযথ ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার জন্য সরকার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে জেল বা জরিমানা সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার হলেও প্রতিরোধ হবে না।

জান্নাতুল কারার তিথি : এডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট

ক্যাটাগরি: মিনি কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল কারার তিথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply