বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে আজ ৫০ বছর হতে চলছে। কিন্তু স্বাধীনতাপ্রাপ্তির লক্ষ্য বিন্দু কি আমরা ছুঁতে পেরেছি? অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতাপ্রপ্তির পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশকে স্বপ্নের কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিচার বিভাগকে ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সংবিধানকে নিজেদের সুবিধার্থে প্রতিটি সরকার বার বার কতর্ন করেছে। আর প্রশাসনিক অদক্ষতা, আমলা-রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব ও সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ক্রমেই বাড়ছে। কিছুতেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
বর্তমানে জাতীয় সংসদে ও সংসদের বাইরে সত্যিকারের শক্তিশালি বিরোধী দলের অস্তিত্ব তেমন নাই বললেই চলে। ফলে রাজনীতিতে মহাশূন্যতা বা গভীর সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সবাইকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে শক্তিশালি বিরোধীদল ছাড়া গণতন্ত্র শক্তপোক্ত হয় না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতি এখন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে নেই। এটা এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে-দুর্বৃত্ত,চাঁদাবাজ, লাঠিয়ালদের দ্বারা। তাই সমাজে দিন দিনই গুম-খুন-লুন্ঠন-ধর্ষণ-টাকা পাচার দ্রুত গতিতে বাড়ছে। মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জ্যামিতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে। সবাই এখন টাকা পেছনে দৌড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেউ বৈধ-অবৈধ এর বাছ বিচার করছে না। চারদিকে চলছে হরিলুটের রাজত্ব। এই সুযোগে কতিপয় লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা নেই; দলের সভাপতি বা সাধারন সম্পাদকের সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে সবাইকে মেনে চলতে হয়। মূলত শুদ্ধ স্বৈরতান্ত্রিকতার চর্চা শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। অথচ তারা নিজেদের দলকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করে!
নির্বাচনের সময় যার টাকা ও পেশি শক্তি বেশি থাকে সে-ই দলের মনোনয়ণ পায়।কিন্তু তৃর্নমূলের সৎ-নিষ্ঠাবান পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা প্রায় সময়ই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে রাজনীতির ময়দানে নেমে আসে ঘোর সংকট। এখনো আমরা এই সংকটের মধ্যেই সময় পার করছি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও এই সংকট থেকে বের হতে পারছি না।
দীর্ঘ এই ৫০ বছরে আমাদের দেশে ক্রমাগত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু পাশাপাশি সমাজ থেকে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক চেহারাটা দিন দিনই হারিয়ে যাচ্ছে। এই ৫০ বছরে অনেক সরকারই ক্ষমতায় এসছে; তারা সাধারণ মানুষকে অনেক নতুন কিছু দেওয়ার মিথ্যা প্রলাপের রঙে আঁকা ছবি দেখিয়েছে। মানুষও মনে করেছে আমরা অনেক কিছু পাচ্ছি! কিন্তু সময় হারিয়ে জনগণ বোঝতে পারছে এটা ছিল রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা দখল করার কূট কৌশল। এভাবে মানুষ প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছে! তবে একথা সত্যি যে, প্রতিটি রাজনৈতিকদল ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্যে শত শত পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে এবং তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টাও করে। কিন্তু হ্যায়! কোনো সরকারই তাদের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে না। কারণ পরবর্তীকালে অন্য রাজনৈতিকদল ক্ষমতায় এসে নিজেদের বাহাদুরী জাহির করার জন্যে পূর্ববর্তী সরকারের যাবতীয় পরিকল্পনা স্থগিত করে দেয়।
এতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়। আমাদের দেশে সরকারি দলগুলো আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। এধরনের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে বিরোধী মত-দর্শন-দল ও গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতিয় সংকট মোকাবিলাকালে সরকারি ও বিরোধী দলগুেলোর মধ্যে কখনো কোনো ধরনের ঐকমত্য হয় না। আমাদের দেশের সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মতো এমন সংকীর্ণচিত্ত পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে সচরাচর দেখা যায় না! সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যকার এমন সাপে-নেউলে সম্পর্ক প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরাট অন্তরায়।
আইনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র পরিচালনার যে সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দরকার ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো সম্পূর্ণভাবে তা এড়িয়ে গেছে। ব্যক্তির চেহারা,অবস্থান দেখে রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর থেকেই এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত প্রধানতম চালিকা শক্তি হিসেবে কার্যকর হয়েছে, আইন নয়। বাস্তবিকপক্ষে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক দলের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। আইনের নিরিখে সবকিছু পরিচালিত হওয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এই অপরিহার্য গুণ প্রয়োগ করতে না পারায় দেশীয় সব সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে। তাই আমাদের কাংখিত গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে। গণতন্ত্রহীনতার লম্বা সংস্কৃতি আমাদের সার্বিক অগ্রগতিকে থমকে দিচ্ছে।
আমাদের সমসাময়িক স্বাধীন দেশগুলো আজ বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু হ্যায়! মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক থাকার পরও আমরা যেই তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। কবে পারবো আমরা যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য-অসমতা, অসহিষ্ণুতা-অমানবিকতা, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি চিরতরে দূরে সাম্য এবং ন্যায়ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে? নাকি আমাদের সেই স্বপ্নের সোনার বংলা অধরাই রয়ে যাবে?
লেখক: খায়রুল আকরাম খান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত, সমকালীন ভাবনা
[sharethis-inline-buttons]