আমাদের দেশে নারীরা সর্বক্ষেত্রেই অবহেলিত ও অনিরাপদ। শিক্ষায় ও নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হলেও সামাজিক কুসংস্কা ও ধর্মীয় অনুশাসনের নানা রকম বাধার কারণে নারীর সর্বিক উন্নতি এখনো ঘটেনি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী হিসেবে তাদের প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান দেখাতে পারিনি। গুটিকতক শীর্ষপদে প্রতিষ্ঠিত নারীদের দিয়ে সার্বিক নারীর অবস্থা বিচার করা যায় না। নারীর সার্বিক পরিবর্তন এখনো বহুদূরে। ভাবতে অবাক লাগে, বর্তমান যুগে আমাদের সমাজে যদি কোনো নারী কোনো ভুল করে অথবা স্বাধীনভাবে কিছু করতে চায়, তখন সে সবার কাছে অপয়া ও অশুভকর হয়ে যায়। সবাই তাকে অপবিত্রভাবে ও অবজ্ঞা করে। এতো প্রতিকূল পরিস্থিতি ডিঙ্গিয়ে সাহসী কোনো নারী সামনে এগোতে চাইলে কেউ উদারমন নিয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আজও আমরা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে গন্য করি।
সমাজ ও রাষ্ট্রের এমনি বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশে ঢাকার চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ঘটে শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনির। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সিনেমা অঙ্গনে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। নিজের আবস্থান শক্তপোক্ত করে নেন। সবাইকে তাকলাগিয়ে এসময়ে তিনি বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বাবিসাস পুরস্কার-২০১৫, মেরিল-প্রথমআলো পুরস্কার-২০১৯,ভারত-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৯,সিজেত্রফবি পাফরম্যান্স পুরস্কার-২০২০ এবং ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রখ্যাত বিজনেস ম্যাগাজিন ফোবর্সে ১০০ জনের তালিকায় নিজের নামের অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু তার এই খ্যাতিতে ঈর্ষাণিত হয়ে সমাজের কিছু লোক তার পেছনে লাগে। অভিজাত শ্রেণির কিছু কুপথগামীদের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে পরীমনি তাদের পাতানো ফাঁদে ফেসে যান।
এরই প্রেক্ষিতে চলিত বছরের ৪ আগস্ট রাতে ঢাকা চলচ্চিত্রের এই উদীয়মান অভিনেত্রী ও মডেলের বানানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেন র্যাব সদস্যরা। পরদিন তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদক আইনে মামলা করা হয়। জব্দ তালিকায় পরীমনির বাসা থেকে `মদ, আইস ও এলএসডির মতো মাদকদ্রব্য` উদ্ধারের কথা মামলার আর্জিতে উল্লেখ করা হয়। সবার স্মরণার্থে বলছি-আইনের বিধান অনুযায়ী গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার বা কারো বাড়ি বা দেহ তল্লাশী করা যায় না। সাদা পোশাকে এবং রাতে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। গ্রেপ্তার করার সময় তার আত্মীয়স্বজন বা তার আইনজীবীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অবহিত করতে হয়। আর মহিলা হলে তাকে মহিলা পুলিশ দ্বারা গ্রেপ্তার করতে হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহীনি পরীমনিকে গ্রেপ্তারের সময় এসব ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।
পরীমিনকে আটক করার পর তাকে পরের দিন দুপুর দিকে ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালতে পাঠানো হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পরির্দশক কাজী গোলামা মোস্তাফার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রথম দফায় ৪ দিন ও দ্বিতীয় দফায় ২ দিনের রিমান্ড দেয় আদালত। যতটুকু জানি,ফৌদারি কার্যবিধিতে রিমান্ডের কোনো বিধান নেই। ফৌদারি আইনের ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আসামিকে জুডিশিয়াল রিমান্ডে নেওয়া যায়,পুলিশ রিমান্ডে নয়। পরীমনি কোনো দুর্ধর্ষ ব্যক্তি নয়,যে সে জামিন পেলে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে। সে সমাজের একজন অভিজাত শ্রেণির লোক। এছাড়াও সে একজন নারী। জামিন পাওয়া তার সাংবিধানীক অধিকার। কেন তার জামিন হচ্ছে না এটা বেশ রহস্যজনক! মূলত পরীমনি প্রভাবশালীদের আক্রোশের শিকার। হয়তো তাদের ইশারায় শুধু একই মামলায় তাকে বার বার পুলিশ রিমান্ডে নিচ্ছে।
রিমান্ডের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টর নির্দেশনার প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা পোষন করছে না পুলিশ ও নিম্ন আদালত। পুলিশ ও আদালতের এহেন আচরণ সত্যিই দুঃখজনক। পরীমনি বর্তমানে গাজিপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রী কারাগারে সাধারণ কয়েদিদের সাথে অবস্থান করছেন। এখানে থেকে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এভাবে লাগাতারভাবে জেলখানায় থাকলে হয়তো সে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও পরীমনি দীর্ঘ দিন কারাগারে আটক থাকলে তার অভিনীত নির্মিতব্য অনেক সিনেমা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে প্রযোজক,পরিচালকসহ রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। অথচ পরীমনির এই দুর্দিনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পীদের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি তার পাশে নেই। পরীমনি এই সংগঠনের তালিকাভুক্ত চিত্রনায়িকা। কিন্তু পরিতাপরে বিষয়, এই সংগঠনের কোনো কোনো সদস্য তার সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্যও কেরেছে। অবশেষে বিশেষ মিটিং করে সাহায্য না করে সমিতির পক্ষ থেকে সভাপতি মিশা সওদাগর পরীমনির সদস্যপদ স্থগিত করেছেন। ব্যাপারটি খুবই দুঃজনক বটে।পরীমনির মতো নিরীহ ও এতিম মহিলাকে গ্রেপ্তার করে আইশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের বাহাদুরী জাহির করার জন্য পরের দিন প্রেস কনফারেন্স করে সাংবাদিকদের নিকট পরীমনির যাবতীয় বর্ণনা দেন। আর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমে ২/৩ দিন যাবৎ ধারবাহিকভাবে রসালো আকারে তা প্রচাতি ও প্রকাশিত হয়। উক্ত খবর পড়ে পাঠকরা নারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন এবং এখনো সেই নেতিবাচক আলোচনা রাস্তাঘাটে, পাড়ার চা -এর দোকানে ,স্টেশনে সর্বত্রই অব্যাহত আছে! অতি উৎসাহী ও কৌতূহলী কিছু পাঠকদের আলোচনায় মনে হচ্ছে দেশে আর কোনো ধরনের সমস্যা নেই। দেশে হাজারো সমস্যা রয়েছে সেই দিকে এসব পাঠকদের কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। একটি লক্ষ্য করার বিষয় যে, দেশে যখন কোনো ধরনের জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়, ঠিক তখন উক্ত সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যত্র ফেরানোর জন্য কিছু দিন পর পর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার উন্মোচন হয় এবং সেটার সমাপ্ত না হতেই আরেকটি নতুন ঘটনার আবির্ভাব ঘটে। এভাবে জনগণ নতুন নতুন ঘটনা জানার জন্য উৎসুক থাকে। আর সুযোগে দেশের আসল সমস্যা ঢাকা পড়ে যায়। এটা অদৃশ্য কোনো শক্তির কাজ কি-না তা অপরাধ বিজ্ঞানী,সমাজ বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষনা করা অত্যন্ত জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দেশের জন্য নিবেদীত প্রাণ সাংবাদিক ভাইদের জ্ঞাতার্থে বলছি-কোনো মামলার তদন্ত চলাকালে তা বাইরে প্রকাশ করা অনুচিত। আদালত কর্তৃক সাজা হওয়া পূর্ব পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী বলা যায় না। “পাবলিক প্রাইভেসী অ্যাক্ট” ধারাটি অটুট রাখা বা এর প্রতি শ্রদ্ধা পোষন করা আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারো সম্পর্কে মানহানিকর কথা বা কারো সম্মানে আঘাত করা গর্হিতকর কাজ। আর এইদিকে আপনাদের দ্বারা প্রকাশিত তথ্য-উপাথ্য নিয়ে তা কাটপিস করে কিছু কিছু রুচিহীন মানুষ পরীমনিকে নিয়ে কিছু কামোদ্দীপকমূলক কাল্পনিক ছবি তৈরি করে “ইউটিউভ “-এ লাগাতারভাবে প্রচার করছে যা, পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে দন্ডনীয় অপরাধের কাজ। আশা করছি আপনারা এইদিকে একটু নজড় দিবেন। কারণ পরীমনি তো আপনার-আমার মতো কারো ভগ্নি,কারো মেয়ে,কারো ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দয়া করে নিজেদের বিবেককে জাগ্রত করুন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তলরের দুর্নীতি সম্পর্কে জনগণকে অহিত করুন। মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করুন। মানুষের চেতনাকে শানিত করুন। মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ সৃষ্টি করুন। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করুন। মানুষকে শিষ্টাচার সম্পর্কে অবহিত করুন।
ঢাকা চলচ্চিত্রের উদীয়মান তারকা পরিমনি ১৯৯২সালের শেষের দিকে সাতক্ষীরা জেলার নড়াইল উপজেলায় এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। খুব ছোটবেলাই সে তার মা-বাবাকে হারান। অতঃপর সে নানারবাড়িতে থেকে বহুকষ্টে এইচএসসি পাস করেন। তার নানার অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিলো না। শৈশকাল থেকেই সে শাবানা-কবরী,সুজাতা-সুচন্দা,সুচিত্রা সেন-সন্ধ্যা রায় এর মতো বিখ্যাত তারকাদের সিনেমা দেখে দেখে বড় হয়েছেন। সেই শৈশবকালে থেকেই তার মনে বাসনা জাগে উক্ত তারকাদের মতো সিনেমায় অভিনয় করার। নিজের অদম্য স্পৃহাকে বাস্তবায়ন করান জন্যে ২০১১ সালে স্থায়িভাবে ঢাকায় চলে আসেন এবং নিজেকে সিনেমার জন্যে তৈরির উদ্দেশ্যে বাফায় ভর্তি হন। এখানে নাচের পাশাপাশি অভিনয়ে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করেন।এখান থেকে নৃত ও অভিনয়ের যাবতীয় কলাকুশল রপ্ত করেন। তারপর মডেলিং ও টিভি নাটকের মাধ্যমে তার কর্মজীন শুরু করেন। এসময় অভিনয় কৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকদের আগ্রহ ও আকর্ষন করতে সক্ষম হন। ২০১৩ সালে তিনি `ভালোবাসা শিমাহিন` চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন।
`রানা প্লাজা` ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের নজড়ে আসেন। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শুরু হয় তার অবিশ্বাস্য উত্থান। এসময় নবাগত হিসেবে ২০ টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন পরীমনি। ঢাকার চলচ্চিত্রে নবাগত হিসেবে এতোগুলো ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্যিই দুস্কর ব্যাপার! হু হু করে বাড়তে থাকে তার জনপ্রিয়তা ও পাশাপাশি অঢেল অর্থ। এই সুবাদে শহরের নামকরা রাজনীতিবিদ, আমলা, শিল্পপতি, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক সাথে তার শুরু হয় ওঠাবসা। এসময় তিনি ঢাকার অভিজাত এলাকায় একাধিক বাড়ি ক্রয় করেন। এই অল্প সময়ে তার এ উত্থান পরশ্রীকাতর ও হিংসুটেরা মোটেই সহ্য করতে পারেনি। তারা উঠেপরে আদাজল খেয়ে নামে পরীমনির পিছু। কথায় বলে,বাঙ্গালী পরশ্রীকাতর জাতির,তার ধ্বংসের জন্যে বাইরের কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই। শিল্পী পরীমনির বেলায় এই কথাটি ১০০% সত্যে পরিনত হয়েছিল।
অবশেষে গত ২২ আগস্ট কোর্ট বদল করে পরীমনির মামলাটি ঢাকার জজ আদালতে আনা হয়। অতঃপর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে পরীমনির জামিনের জন্য তার আইনজীবী মজিবুর রহমান আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর জামিন শুনানির দিন ধার্য করে। এই দিকে ওই দিন বিকাল দিকে “বিক্ষুদ্ধ নাগরিকজন” এর ব্যানারে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। উক্ত সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন-শাহরিয়ার কবির সুলতানা কামাল, খুশী কবির, অধ্যাপক সাদেকা হালিম,অধ্যাপক রেজওয়ান করিম,চলচ্চিত্রকার রাশিদ পলাশ, রবিন আহসান ও অপরাজিতা সংগীতা। এরা সবাই মরীমনির দ্রুত জামিন কামনা করেন।
বস্তুত পরীমনির রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেননি।
খুন, হত্যা, গুমের মতো কোনো ধরনের ভয়াবহ অপরাধ করেননি। সে কোনো সন্ত্রাসী বা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক নন, তাহলে তাকে জামিন দিতে আদালত কেন টালবাহান করছে। ব্যাপারটি খুবই রহস্যজনক। পরীমনি যদি সত্যিকারভাবে কোনো ধরনের অপরাধ করে থাকেন,তাহলে আদালতে তার বিচার হবে। কিন্তু কোনো ধরনের হেনস্তা করার দায়িত্বতো রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়নি। আশা করছি আগামী শুনানির সময় ন্যায় বিচারের স্বার্থে সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞ বিচারক পরীমনিকে জামিনে মুক্তি দিয়ে তাকে তার পেশাগত ও পারিবারিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ করে দিবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট http://www.deshdorshon.com/2021/08/
Some text
ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা, নিয়ম-কানুন
[sharethis-inline-buttons]